আইন ও বিচারদেশপরিবেশবাংলাদেশবিশ্লেষণমতামতসংগৃহীত সংবাদ

ভূষণছড়া গণহত্যা: বিচারহীনতার চার দশকেও শুকায়নি ক্ষতের দাগ

বিশেষ প্রতিবেদন: পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ ও নৃশংস গণহত্যা হিসেবে পরিচিত ভূষণছড়া হত্যাকাণ্ড। আজ থেকে প্রায় ৪১ বছর আগে, ১৯৮৪ সালের ৩১ মে, রাঙ্গামাটির বরকল উপজেলার ভূষণছড়া নামক এক প্রত্যন্ত জনপদে সংঘটিত হয়েছিল এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। তৎকালীন বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সংগঠন ‘শান্তিবাহিনী’র আক্রমণে নারী-শিশুসহ ৪০০ জনেরও বেশি বাঙালি অধিবাসী নির্মমভাবে নিহত হন। কিন্তু চার দশক পেরিয়ে গেলেও এই বর্বরোচিত গণহত্যার কোনো আনুষ্ঠানিক তদন্ত বা বিচার হয়নি, যা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর জন্য এক অন্তহীন বেদনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সেই কালরাতের ভয়াবহতা

ঘটনার দিনটি ছিল পবিত্র রমজান মাস। ৩১ মে, ১৯৮৪ সালের ভোররাত। ভূষণছড়া গ্রামের বাসিন্দারা সাহরি খেয়ে যখন ঘুমের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, ঠিক তখনই প্রায় ১৫০ জনের একটি সশস্ত্র দল অতর্কিতে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি’র (জেএসএস) সামরিক শাখা শান্তিবাহিনীর সদস্যরা আগ্নেয়াস্ত্র, বেয়নেট ও ধারালো দেশীয় অস্ত্র নিয়ে নিরস্ত্র মানুষের ওপর নারকীয় তাণ্ডব চালায়।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ অনুযায়ী, হামলাকারীরা প্রথমে গ্রামের ঘরবাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। ঘুমন্ত অবস্থাতেই অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যায় বহু পরিবার। ভোর ৪টা থেকে সকাল সাড়ে ৮টা পর্যন্ত চলা এই হত্যাযজ্ঞে নারী, শিশু, বৃদ্ধ—কেউই রেহাই পায়নি। গর্ভবতী নারীদের পেট চিরে ফেলা, শিশুদের হত্যা এবং নারীদের গণধর্ষণের মতো অবর্ণনীয় নৃশংসতা চালানো হয়। হামলাটি দুই ধাপে চালানো হয়; ভোরের প্রথম হামলার পর সন্ত্রাসীরা চলে গেছে ভেবে যখন প্রাণে বেঁচে যাওয়া মানুষেরা জঙ্গল থেকে ঘরে ফিরতে শুরু করে, তখনই দ্বিতীয় ও আরও ভয়াবহ আক্রমণটি চালানো হয়।

এই হামলায় প্রায় ১৬০০ পরিবারের মধ্যে তিন শতাধিক পরিবার সরাসরি আক্রান্ত হয় এবং শতাধিক পরিবার সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।

গণহত্যার প্রেক্ষাপট

সত্তরের দশকের শেষ দিকে বাংলাদেশ সরকার দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ভূমিহীন বাঙালি পরিবারগুলোকে পার্বত্য চট্টগ্রামের সরকারি খাস জমিতে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয়। সরকারের লক্ষ্য ছিল জনসংখ্যার সুষম বণ্টন এবং পার্বত্য অঞ্চলের উন্নয়ন। কিন্তু জেএসএস এবং শান্তিবাহিনী এই পুনর্বাসন কর্মসূচির তীব্র বিরোধিতা করে এবং এটিকে বাঙালি বিতাড়নের অংশ হিসেবে দেখে। এই বিরোধিতার জের ধরেই ভূষণছড়ার মতো নিরস্ত্র বাঙালি জনপদের ওপর এই পরিকল্পিত হামলা চালানো হয় বলে মনে করা হয়।

বিচারহীনতার দীর্ঘ অধ্যায়

এত বড় একটি গণহত্যা সংঘটিত হলেও তৎকালীন সরকার রাজনৈতিক কারণে বিষয়টি ধামাচাপা দেয় বলে জোরালো অভিযোগ রয়েছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যেন এর কোনো প্রতিক্রিয়া না হয়, সেজন্য ঘটনাটি প্রচারে বাধা দেওয়া হয়। ক্ষতিগ্রস্তরা বারবার চেষ্টা করা সত্ত্বেও বরকল থানায় কোনো মামলা পর্যন্ত নথিভুক্ত করা হয়নি; শুধুমাত্র একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেই দায় সারা হয়।

তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের ঘোষণা দিলেও তা যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়নি বলে অভিযোগ করেন বেঁচে ফেরা মানুষেরা। নিহতদের পরিবারকে দুই একর জমি ও অর্থ সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও বাস্তবে সামান্য কিছু নগদ টাকা ও এক বস্তা চাল দিয়েই দায়িত্ব শেষ করা হয়।

দীর্ঘ ৪১ বছর ধরে এই গণহত্যার শিকার পরিবারগুলো বিচারের আশায় পথ চেয়ে আছে। তাদের দাবি, এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে দ্রুত বিচারের আওতায় আনা হোক। শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার এত বছর পরেও পাহাড়ে কাঙ্ক্ষিত শান্তি ফিরে না আসার পেছনে ভূষণছড়ার মতো অমীমাংসিত ক্ষতগুলোকেই দায়ী করেন অনেকে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button