অপরাধআইন ও বিচারদেশবাংলাদেশবিশ্লেষণমতামতসংগৃহীত সংবাদ

যে ঋণ শোধ হবার নয়: এক বাবার আত্মত্যাগ ও ছেলের উপলব্ধির গল্প

ডেস্ক রিপোর্ট: বাবার ঠিকানা বৃদ্ধাশ্রমে নির্দিষ্ট করে দিয়ে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বাড়ির পথে ফিরছিল একমাত্র ছেলে। পথিমধ্যেই বেজে উঠল তার মোবাইল ফোন। অপর প্রান্ত থেকে ভেসে এলো স্ত্রীর কঠোর নির্দেশ: “একবার বৃদ্ধাশ্রমে ফিরে যাও। বাবাকে ভালোভাবে বুঝিয়ে দিয়ে এসো, যেকোনো উৎসব-পার্বণ, এমনকি তোমার জন্মদিনের অনুষ্ঠানেও তিনি যেন এখানে আসার কথা চিন্তা না করেন।”

স্ত্রীর এই নির্মম কথায় মনটা আরও বিষিয়ে উঠলেও, অনিচ্ছা সত্ত্বেও ছেলেটি আবার বৃদ্ধাশ্রমের দিকে রওনা হলো। কিন্তু সেখানে পৌঁছে এক অপ্রত্যাশিত দৃশ্য তার চোখে পড়ল। তার বাবা বৃদ্ধাশ্রমের মালিকের সঙ্গে খোশগল্পে মগ্ন, দুজনের মুখেই নির্মল হাসি। দৃশ্যটি দেখে ছেলের মনে খটকা লাগল। বাবা কি এই ভদ্রলোককে আগে থেকেই চেনেন?

বাবার কথা শেষ হওয়ার অপেক্ষায় রইল সে। তিনি নিজের কক্ষে চলে যাওয়ার পর, ছেলেটি কৌতূহল দমন করতে না পেরে আশ্রমের মালিকের কাছে গেল। বিনয়ের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করল, “কিছু মনে করবেন না, আমার বাবাকে আপনি যেভাবে আপ্যায়ন করছিলেন, তাতে মনে হলো আপনারা পূর্বপরিচিত। ব্যাপারটা কি সত্যি?”

বৃদ্ধ মালিক এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে শান্ত স্বরে উত্তর দিলেন, “হ্যাঁ, আমি তাকে প্রায় চল্লিশ বছর ধরে চিনি। আজ তিনি কোন পরিস্থিতিতে এখানে এসেছেন তা আমার জানা নেই, তবে মানুষ হিসেবে তিনি এককথায় অসাধারণ।”

ছেলের কৌতূহল আরও বাড়ল। সে অধীর হয়ে বলল, “আমি ঠিক এটাই জানতে চাইছি। আপনারা একে অপরকে কীভাবে চেনেন?”

আশ্রমের মালিক কিছুক্ষণ চুপ থেকে যা বললেন, তা শোনার জন্য ছেলেটি প্রস্তুত ছিল না। তিনি বললেন:
“চল্লিশ বছর আগে, আমার এই প্রতিষ্ঠানটি যখন একটি অনাথ আশ্রম ছিল, তখন আপনার বাবা এখান থেকে একটি অনাথ শিশুকে দত্তক নিয়েছিলেন। আমার স্মৃতি যদি প্রতারণা না করে, তবে চল্লিশ বছর আগে দত্তক নেওয়া সেই অনাথ শিশুটিই আজ আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।”

এই একটি বাক্যই ছিল যথেষ্ট। ছেলেটির পায়ের তলার মাটি যেন সরে গেল। মুহূর্তেই তার চোখের সামনে ভেসে উঠল চল্লিশ বছরের স্নেহ-মমতা আর ভালোবাসার একেকটি দৃশ্য। সে বুঝতে পারল, যাকে সে নিজের জন্মদাতা পিতা জেনে এসেছে, তিনি আসলে তার চেয়েও অনেক বড়—তিনি তার জীবনদাতা।

চোখের জল আর ধরে রাখতে পারল না ছেলেটি। অনুশোচনার আগুনে পুড়তে পুড়তে সে দৌড়ে গেল বাবার কক্ষে। বাবার পায়ে লুটিয়ে পড়ে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল, “বাবা, আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি। মাত্র দুদিনের ভালোবাসার জন্য তোমার চল্লিশ বছরের নিঃস্বার্থ ভালোবাসাকে আমি বৃদ্ধাশ্রমে ফেলে যাচ্ছিলাম।”

ছেলের কান্নায় বাবার চোখও ভিজে উঠল। তিনি ছেলেকে পা থেকে তুলে বুকে জড়িয়ে নিলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, “আরে বোকা ছেলে, এতে কাঁদার কী আছে? আমি তোকে কবেই ক্ষমা করে দিয়েছি।”

বাবার এই কথায় ছেলের বুকের ভেতরটা যেন আরও দুমড়ে-মুচড়ে গেল। সে বাবাকে ওইদিনই পরম যত্নে নিজের বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে গেল।

এই গল্পটি পৃথিবীর সকল বাবার নিঃস্বার্থ ভালোবাসা ও আত্মত্যাগের প্রতি এক গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button