মূতার প্রান্তরে ঈমান ও আত্মত্যাগের অমর গাঁথা
ইসলামিক বিচিত্রা ডেস্ক: ইসলামের ইতিহাসে এমন কিছু অধ্যায় রয়েছে যা কেবল যুদ্ধের বর্ণনা নয়, বরং ঈমানের দৃঢ়তা, অকল্পনীয় আত্মত্যাগ এবং আল্লাহর প্রতিশ্রুতির ওপর অবিচল আস্থার এক জীবন্ত দলিল। এমনই এক অবিস্মরণীয় ঘটনা হলো অষ্টম হিজরিতে সংঘটিত ‘মূতার যুদ্ধ’, যেখানে মুসলিম সেনাপতিরা শহীদি তামান্না নিয়ে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন।
শাহাদাতের অনুপ্রেরণা: কুরআন ও হাদিসের বাণী
মুসলিম যোদ্ধাদের এই আত্মত্যাগের মূল প্রেরণা ছিল মহান আল্লাহর প্রতিশ্রুতি। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা’আলা বলেন:
“নিশ্চয়ই আল্লাহ মুমিনদের থেকে তাদের জীবন ও সম্পদ জান্নাতের বিনিময়ে কিনে নিয়েছেন। তারা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে, হত্যা করে এবং নিহত হয়। তাওরাত, ইনজিল ও কুরআনে এ সম্পর্কে তাদের দৃঢ় প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। আর আল্লাহর চেয়ে বড় প্রতিশ্রুতি রক্ষাকারী আর কে আছে? সুতরাং তোমরা যে সওদা করেছ, তার জন্য আনন্দিত হও। আর এটাই তো মহাসাফল্য।” (সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ১১১)
একইভাবে, আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর বাণীও তাঁদের জন্য ছিল অনুপ্রেরণার বাতিঘর। আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সাঃ)-কে সর্বোত্তম আমল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, “আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর বিশ্বাস স্থাপন করা।” এরপর জিজ্ঞেস করা হলো, “তারপর কোনটি?” তিনি বললেন, “আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা।” (সহিহ বুখারী)
মূতার যুদ্ধ: এক অসম সমর
এই ঈমানী চেতনায় উজ্জীবিত হয়েই অষ্টম হিজরিতে মহানবী (সাঃ) সিরিয়ার সীমান্তে রোমান বাহিনীর বিরুদ্ধে একটি সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন। মাত্র তিন হাজার মুসলিম সেনার বিপরীতে শত্রুপক্ষে ছিল এক লাখ রোমান সৈন্য এবং তাদের সহযোগী আরও এক লাখ আরব খ্রিষ্টান সৈন্য। এই অসম যুদ্ধে রাসূল (সাঃ) তিনজন সেনাপতি নির্ধারণ করে দেন। তিনি বলেন, প্রথমে সেনাপতিত্ব করবেন যায়েদ ইবনে হারিসা (রাঃ)। তিনি শহীদ হলে জাফর ইবন আবি তালিব (রাঃ) এবং তিনিও শহীদ হলে ইবন রাওয়াহা (রাঃ) সেনাপতিত্ব করবেন।
তিন সেনাপতির অকল্পনীয় বীরত্ব
যুদ্ধ শুরু হলে প্রথম সেনাপতি যায়েদ ইবনে হারিসা (রাঃ) বীরত্বের সাথে লড়াই করে শাহাদাত বরণ করেন। এরপরই ইসলামের পতাকা হাতে তুলে নেন রাসূল (সাঃ)-এর চাচাতো ভাই জাফর ইবন আবি তালিব (রাঃ)। তিনি শত্রুবাহিনী যেন তাঁর ঘোড়াটি ব্যবহার করতে না পারে, তাই সেটিকে হত্যা করে পদাতিক হিসেবেই রোমান বাহিনীর গভীরে প্রবেশ করেন।
যুদ্ধের এক পর্যায়ে তাঁর ডান হাত কেটে গেলে তিনি বাম হাতে পতাকা তুলে ধরেন। কিছুক্ষণ পর তাঁর বাম হাতও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তবুও তিনি ইসলামের পতাকাকে ভূলুণ্ঠিত হতে দেননি। দুই বাহু দিয়ে পতাকা বুকে চেপে ধরে তিনি যুদ্ধ চালিয়ে যান। অবশেষে তরবারির আঘাতে তাঁর দেহ দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়। শাহাদাতের পর তাঁর দেহে নব্বইটিরও বেশি আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়, যার প্রতিটিই ছিল সামনের দিকে—এক মুহূর্তের জন্যও তিনি পশ্চাদপসরণ করেননি।
এরপর তৃতীয় সেনাপতি আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহা (রাঃ) পতাকা হাতে তুলে নেন এবং বীরবিক্রমে যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হন। পরবর্তীতে খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাঃ) সেনাপতিত্বের দায়িত্ব নিয়ে অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে মুসলিম বাহিনীকে রক্ষা করেন। এই অসম যুদ্ধে মাত্র ১২ জন মুসলিম শহীদ হন, বিপরীতে রোমান বাহিনীর হাজার হাজার সৈন্য নিহত হয়।
শাহাদাতের পরের করুণ দৃশ্য ও রাসূলের (সাঃ) ভালোবাসা
তিনজন প্রিয় সেনাপতির শাহাদাতের সংবাদে রাসূল (সাঃ) গভীরভাবে ব্যথিত হন। তিনি জাফরের (রাঃ) বাড়িতে গেলে তাঁর স্ত্রী আসমা (রাঃ) সন্তানদের নিয়ে স্বামীর ফেরার অপেক্ষায় ছিলেন। রাসূল (সাঃ) অশ্রুসিক্ত নয়নে শিশুদের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন এবং তাঁদের শাহাদাতের খবর জানান। সেই খবরে পুরো পরিবারে শোকের ছায়া নেমে আসে। রাসূল (সাঃ) তাঁর স্ত্রীদেরকে জাফরের পরিবারের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করার নির্দেশ দেন।
জান্নাতের সুসংবাদ ও জাফরের (রাঃ) মহত্ত্ব
জাফরের (রাঃ) শাহাদাতে রাসূল (সাঃ) দীর্ঘদিন শোকাহত ছিলেন। তখন জিবরীল (আঃ) এসে সুসংবাদ দেন যে, আল্লাহ তা’আলা জাফরকে তাঁর দুটি কর্তিত হাতের বিনিময়ে জান্নাতে দুটি ডানা দান করেছেন, যা দিয়ে তিনি ফেরেশতাদের সাথে উড়ে বেড়ান। এ কারণে তিনি ‘যুল-জানাহাইন’ (দুই ডানাওয়ালা) উপাধিতে ভূষিত হন।
জাফর (রাঃ) কেবল একজন বীর যোদ্ধাই ছিলেন না, তিনি ছিলেন গরিব-দুঃখীদের আশ্রয়স্থল। আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, “আমাদের মতো গরিবদের জন্য জাফর ইবন আবি তালিব ছিলেন শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি।” রাসূল (সাঃ) তাঁকে এতটাই ভালোবাসতেন যে বলতেন, “চরিত্র ও দৈহিক গঠনে তুমি আমার মতো।”
এই মহান সাহাবিদের আত্মত্যাগই ইসলামের ভিতকে সুদৃঢ় করেছে। “মরলে শহীদ বাঁচলে গাজী”—এই চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে তাঁরা যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন, তা যুগ যুগ ধরে মুসলিম উম্মাহর জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।



