অপরাধদেশপ্রতারনাবাংলাদেশবিশ্লেষণ

টাইলস কিনছেন? সতর্ক না হলেই পকেট ফাঁকা

দাম যাচাইয়ে বাধা, গ্রেডে কারচুপি আর হিসাবে গরমিল—অসাধু ব্যবসায়ীদের অভিনব প্রতারণা

বিশেষ প্রতিবেদন: স্বপ্নের বাড়ি বা ফ্ল্যাট সাজাতে টাইলসের জুড়ি নেই। কিন্তু এই প্রয়োজনীয় পণ্যটি কিনতে গিয়েই এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীর পাতা ফাঁদে পড়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন বহু ক্রেতা। দোকানে ছবি তুলতে বাধা দেওয়া থেকে শুরু করে ইচ্ছাকৃত ভুল হিসাব আর পরিবহনের নামে অতিরিক্ত অর্থ আদায়—নানা কৌশলে ক্রেতাদের পকেট কাটছে একটি চক্র। সম্প্রতি একজন ভুক্তভোগীর অভিজ্ঞতার আলোকে টাইলস বাজারের প্রতারণার নানা দিক এখানে তুলে ধরা হলো।

কৌশল ১: দাম যাচাইয়ে বাধা

বেশিরভাগ টাইলসের দোকানে “ছবি তোলা নিষেধ” লেখা থাকে। এর মূল উদ্দেশ্য হলো, ক্রেতা যেন পণ্যের মডেল বা ডিজাইন নিয়ে অন্য দোকানে দাম যাচাই করতে না পারেন। এই সুযোগে বিক্রেতারা বড় আকারের টাইলসের ক্ষেত্রে প্রতি বর্গফুটে নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে ৬ থেকে ১৪ টাকা পর্যন্ত বেশি রাখেন। যেমন, আপনার যদি ৮০০ বর্গফুট টাইলস প্রয়োজন হয় এবং বিক্রেতা প্রতি ফুটে মাত্র ৩ টাকাও বেশি রাখেন, তাহলেও আপনার পকেট থেকে অতিরিক্ত ২,৪০০ টাকা চলে যাবে।

করণীয়: সুযোগ থাকলে গোপনে পণ্যের ছবি তুলুন অথবা ব্র্যান্ড ও মডেল নম্বর জেনে নিন। এরপর মূল কোম্পানির ফেসবুক পেজে সরাসরি মেসেজ দিয়ে বা ইউটিউবে বিভিন্ন ভিডিও দেখে সঠিক দাম সম্পর্কে ধারণা নিন। RAK, MIR-এর মতো প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ডগুলো সাধারণত তাদের অফিশিয়াল পেজে সঠিক তথ্য দিয়ে সহায়তা করে।

কৌশল ২: ‘এ’ গ্রেডের দামে ‘বি’ গ্রেডের পণ্য

অনেক দোকানে সেরা মানের ‘এ’ গ্রেডের টাইলসের স্যাম্পল সাজানো থাকলেও বিক্রির সময় ধরিয়ে দেওয়া হয় নিম্নমানের ‘বি’ গ্রেড। ‘বি’ গ্রেডের টাইলসে কোনা ভাঙা, ফিনিশিংয়ে সমস্যা বা সামান্য তারতম্যের মতো ত্রুটি থাকে।

করণীয়: কোনো দোকানে যাওয়ার আগে মূল কোম্পানির সাথে যোগাযোগ করে তাদের অনুমোদিত ডিলারের তালিকা চেয়ে নিন। আসল ডিলারের কাছ থেকে কিনলে মানহীন পণ্য পাওয়ার ঝুঁকি কমে যায়।

কৌশল ৩: মেমো বা চালানে ইচ্ছাকৃত ভুল

দোকানের ম্যানেজার বা বিক্রয়কর্মীরা মেমো তৈরির সময় প্রায়ই ইচ্ছাকৃতভাবে হিসাবে গরমিল করেন। অনেক সময় মুখে যে দাম বলা হয়, মেমোতে প্রতি বর্গফুটে ৫০ পয়সা বা ১ টাকা বাড়িয়ে লেখা হয়। সামান্য এই পার্থক্য বিপুল পরিমাণ টাইলসের ক্ষেত্রে কয়েক হাজার টাকায় গিয়ে দাঁড়ায়। একজন ভুক্তভোগী জানান, তাকে ১৬/১৬ মাপের একটি টাইলসের দাম প্রতি বর্গফুট ৬৩ টাকা বলা হলেও মেমোতে ৬৩.৫০ টাকা লেখা হয়। তার ১৩০০ বর্গফুট টাইলসের প্রয়োজনে বাড়তি ৬৫০ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে, বিক্রয়কর্মীদের বেতন কম হওয়ায় তারা এ ধরনের কৌশলে ক্রেতাদের কাছ থেকে বাড়তি টাকা আদায় করে নিজেদের পকেট ভরেন।

কৌশল ৪: পরিবহন ও লেবার খরচের ফাঁদ

পণ্য ডেলিভারির সময় পরিবহন ও লেবার চার্জের নামে বড় অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। অনেক সময় প্রতি বক্সে লেবার চার্জ ৫ টাকা বলা হলেও বড় টাইলসের অজুহাতে তা ১০ টাকা করে আদায় করা হয়। বিক্রেতারা তাদের নিজস্ব পরিবহনে পণ্য পাঠাতে গ্রাহককে একরকম বাধ্য করেন। অন্য গাড়ি দিয়ে পণ্য নিলে ভেঙে যাওয়ার ভয় দেখিয়ে হুমকিও দেওয়া হয়। একজন ক্রেতা জানান, মাত্র ৪ কিলোমিটার দূরত্বের জন্য তার কাছে লেবার চার্জসহ ভ্যান ভাড়া চাওয়া হয়েছিল ৮,০০০ টাকা। অথচ তিনি নিজে একটি পিকআপ ভাড়া করে লেবারসহ মাত্র ২,০০০ টাকায় কাজটি সম্পন্ন করেন।

টাইলসের ব্যবসা বর্তমানে একটি প্রতারণার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে, যেখানে সবচেয়ে সহজ লক্ষ্যবস্তু হলেন প্রবাসীরা। মধ্যপ্রাচ্য বা মালয়েশিয়া থেকে যারা দেশে বাড়ি করছেন, তাদের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে একটি চক্র বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। তাই, টাইলস কেনার আগে ভালোভাবে বাজার যাচাই, অনুমোদিত ডিলার খুঁজে বের করা এবং প্রতিটি হিসাব নিজে মিলিয়ে নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। अन्यथा স্বপ্নের বাড়ি সাজানোর প্রথম ধাপেই বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির শিকার হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button