নোয়াখালী প্রতিনিধি: আমাদের সমাজে প্রতারণার শেষ নেই। নানা ভাবে প্রতারণা করে যাচ্ছে প্রতারকরা। এরা কখনো ভদ্রবেশে, কখনো রাজনীতিবিদ সেজে, কখনোবা সমাজসেবক হিসেবে আবির্ভুত হয়। এই প্রতারকরা এতই ধুর্ত যে এদের প্রকৃত স্বরুপ চেনা খুবই কঠিন, কেউ ধরা পড়েন, কেউ ধরা পড়ার আগেই অর্থ বিত্ত-ভৈবব গড়ে তোলেন। যখন যে সরকার ক্ষমতায় আসেন তাদের ম্যানেজ করে চলেন। পদ পদবিও বাগিয়ে নেন। করোনাকালীন সময়ে বাটপার সাহেদ করিমের কথা আমরা সবাই জানি। ঠিক এমনই একজন প্রতারক নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার রাজগঞ্জ ইউনিয়নের রাজুল্লাপুর গ্রামের প্রয়াত মাজহারুল হকের পুত্র মোজাম্মেল হক সেলিম ওরফে এসি সেলিম। বাবা ছিলেন গাড়ি চালক। স্কুলের গন্ডি পেরুতে না পারা সেলিম ঢাকায় এসে গাড়ীর এসি মেরামতের দোকানে চাকুরি নেন। পরবর্তীতে নিজেই এসির মর্টরপার্টস এর দোকান দেন। কিন্তু ইস্কাটনে নজরুল এসি নামে যে দোকান তিনি ভাড়া নেন ভূয়া কাগজ-পত্র বানিয়ে মালিক পক্ষকে ভয়ভীতি দেখিয়ে পরবর্তীতে সেই দোকানেরই মালিক বনে যান এই প্রতারক সেলিম। এ বিষয়ে দোকানের মালিক বলেন, আমরা বুঝতেই পারিনি সেলিম যে এতোবড় ধোকাবাজ ও প্রতারক। সে আমাদের দোকান ভাড়া নিয়ে আমাদেরও দোকান দখল করে নেয়। আমরা তার উপযুক্ত বিচার দাবি করছি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সেলিমের অন্যতম কৌশল হলো এসি মেরামতের জন্য আসা সরকারী কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদসহ নানা শ্রেনী-পেশার মানুষের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলা এবং এসব সম্পর্ক দেখিয়ে মানুষকে প্রলোভনে ফেলে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেয়া। বাকপটু সেলিম এমন ভাবে নিজেকে উপস্থাপন করে যে, মন্ত্রনালয়ের সচিব কিংবা পুলিশের উর্ধ্বতন কর্তা কিংবা দেশের প্রথিতযশা ব্যবসায়ীরা তারা ঘনিষ্ঠজন। খ্যতিমান ব্যাক্তিদের সাথে তার দহরম মহরম সম্পর্কের কথাও বলে বেড়ান সেলিম। কাউকে চাকুরী দেয়ার নামে, কাউকে ব্যবসায়িক কাজ পাইয়ে দেয়া কিংবা রাজনৈতিক পদ-পদবী দেয়ার নামে মানুষের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন সেলিম। সম্প্রতি নোয়াখালীর পুলিশের এক উর্ধতন কর্মকর্তাকে দেখিয়ে পোস্টিং করে দিবেন বলে এক ওসির কাছ থেকে ৭ লাখ টাকা নেন। পোস্টিং করে দিতে না পেরে এখন তাকে এড়িয়ে চলছেন। ট্যাক্স মওকুপের নামে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে দেখিয়ে হুদা কন্সট্রাকশনের এমডি নুরুল হুদার কাছ থেকে নেন ৩০ লাখ টাকা। নুরুল হুদার বাড়ী সেলিমের পাশর্^বর্তী ছয়ানী ইউনিয়নে। ট্যাক্স মওকুপ করতে না পেরে টাকা নিয়ে লাপাত্তা সেলিম এখন তার ফোন ধরছেননা। এ বিষয়ে ভূক্তভেগী নুরুল হুদা বলেন, আমার ট্যাক্স মওকুপের কথা বলে আমার কাছ থেকে একে একে ৩০ লাখ টাকা নিয়েছে। কিন্তু আমার কোন কাজই করতে পারেনি। এখন তাকে ফোনেও পাওয়া যায়না। বড় বেকায়দায় পড়েছি। এলাকার মানুষ হিসেবে তাকে বিশ^াস করে এখন প্রতারনার শিকার হলাম। তার উপযুক্ত বিচার হওয়া দরকার।
সেলিম তার এলাকার মানিক মোল্লার ছেলেকে কৃষি মন্ত্রনালয়ে চাকুরী দেয়ার কথা বলে ৩ লাখ টাকা নিয়ে এখন তাদের সাথে যোগাযোগ নেই দীর্ঘদিন। গুরুত্বপূর্ন পদ দেয়ার কথা বলে ইউনিয়ন বিএনপির পদ প্রত্যাশী এক নেতার কাছ থেকেও আড়াই লাখ টাকা নেন সেলিম। কিন্তু তাকেও কোন পদ দিতে পারেননি। জেলা বিএনপির একজন প্রভাবশালী নেতাকে ফ্ল্যাট কিনে দেয়ার কথা বলেও মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেয় সেলিম, পরবর্তীতে তার হুমকী-ধামকিতে কিছু টাকা ফেরৎ দিতে বাধ্য হয় সেলিম।
এভাবে প্রতারক সেলিমের কাছে প্রতারিত হন তার নিজ বাড়ীর আবদুল জলিল। কয়েক বছর আগে জলিল গাড়ী চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করবে বলে সিদ্ধন্ত নেন। জলিল গাড়ী কিনবে এ খবর শোনামাত্র সেলিম তার পিছু নেয়, পরে তাকে একটা চোরাই গাড়ী(প্রাইভেটকার) কিনে দেয় ১০ লাখ টাকা দিয়ে। কয়েকদিন পরই জলিল পুলিশের হাতে ধরা পড়ে চোরাই গাড়ী কিনার অপরাধে। কয়েকমাস জেলও খাটে অসহায় জলিল।
আবদুল জলিল জানান, আমি ভাবতেও পারিনি সেলিম আমার সাথে এমন প্রতারনা করবে। তাকে এখন আর এলাকায় ও ঢাকায় পাওয়া যাচ্ছেনা। আমি চরম ভাবে হয়রানির শিকার।
এভাবেই অসংখ্য মানুষকে পদ-পদবী, চাকুরী, ট্রান্সফার-কিংবা ব্যবসায়িক কাজ পাইয়ে দেয়ার কথা বলে সেলিম কোটি কোটি টাকা মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়ে গা ঢাকা দেন। ভূক্তভোগীরা বছরের পর বছর তার পিছনে হেঁটে টাকা উদ্বার করতে পারছেননা। সেলিমের নিজ এলাকার এক প্রতিবেশী বলেন, সেলিম ঢাকায় দোকান দিলেও ব্যবসা বাণিজ্য তেমন একটা নেই, মূলত ধান্দা-ফিকির, বাটপাটি করেই মে অর্থ উপার্জন করছে। স্কুলের গন্ডি পেরোতে না পারা সেলিম নিজেকে পরিচয় দেন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে। চলনে, বলনে কথনেও বেশ পরিপাটি সেলিম। মানুষকে ম্যানেজ করার কায়দাও বেশ ভালোভাবে জানেন তিনি। নোয়াখালীর কে কোথায় ভালো জায়গায় আছেন পদায়ন বা পোস্টিং হওয়ার সাথে সাথেই ফুল নিয়ে সবার আগে তার দরজায় হাজির হন সেলিম। অনেক সময় এসব প্রতিষ্ঠিত লোকেরাও তার কথায় দিগভ্রান্ত হয়ে যান। বিগত দিনে সব সময়ে আওয়ামীলীগ নেতাদের সাথে সুসম্পর্ক রাখা সেলিম নানা কৌশলে হঠাৎ জাতীয়তাবাদী কৃষক দলের কেন্দ্রীয় নেতা বনে যান। বিগত দিনে জেলা-উপজেলা আওয়ামীলীগের নেতাদের সাথ্যে সখ্যতা থাকা সেলিম নিয়মিত নোয়াখালী-৪ আসনের সাবেক এমপি একরামুল করিম চৌধুরীর ফেসবুক পোস্ট শেয়ার দিতেন। সবার সাথে লিয়াজোঁ রাখা ধুর্ত সেলিম গুরুত্বপূর্ন ব্যাক্তিদের গোপনীয়তা লংঘন করেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। ভূক্তভোগিরা জানান, সেলিমের ভাই সাইফুল ইসলাম ওরফে বাহার চৌধুরীও অনেক বড় প্রতারক। মিথ্যা মামলা দায়েরকারী সিন্ডিকেটের অন্যতম হোতা বাহারকে নিয়ে বিভিন্ন গনমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয়েছে বলেও তারা জানান।
ভূক্তভোগীরা দ্রæত প্রতারক মোজাম্মেল হক সেলিম ওরফে এসি সেলিমকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানান।
এ বিষয়ে অভিযুক্ত মোজাম্মেল হক সেলিম ওরফে এসি সেলিমকে বাড়িতে পাওয়া যায়নি। মোবাইলে কল করলেও বন্ধ পাওয়া যায়।



