আল্লাহর স্মরণ ও কৃতজ্ঞতা: প্রতিদান ও পুরস্কারের ঐশী প্রতিশ্রুতি সূরা বাকারার ১৫২ নম্বর আয়াতের শিক্ষা ও তাৎপর্য

ইসলামিক বিচিত্রা ডেস্ক: পবিত্র কুরআনের সূরা আল-বাকারার ১৫২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদের সঙ্গে এক গভীর ও প্রতিদানমূলক সম্পর্কের রূপরেখা দিয়েছেন। এই আয়াতে তিনি দুটি সুস্পষ্ট আদেশ এবং তার বিনিময়ে একটি মহৎ প্রতিশ্রুতি প্রদান করেছেন।
আল্লাহ তাআলা বলেন:
“সুতরাং তোমরা আমাকে স্মরণ করো, আমিও তোমাদেরকে স্মরণ করবো। আর আমার প্রতি কৃতজ্ঞ হও এবং অকৃতজ্ঞ হয়ো না।”
ইসলামী গবেষক ও তাফসীরকারকদের মতে, এই আয়াতটি অবতীর্ণ হওয়ার প্রেক্ষাপট অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কিবলা পরিবর্তনের মতো একটি মহান নেয়ামত (কাবা শরীফকে স্থায়ী কিবলা নির্ধারণ) মুসলমানদের দান করার পরপরই আল্লাহ তাআলা এই নেয়ামতের শুকরিয়া বা কৃতজ্ঞতা আদায়ের নির্দেশ দেন, যা এই আয়াতের গুরুত্বকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
আল্লাহর স্মরণ: প্রতিদানের অনন্য ঘোষণা
আয়াতের প্রথম অংশে “তোমরা আমাকে স্মরণ করো, আমিও তোমাদেরকে স্মরণ করবো”–এই বাক্যটি আল্লাহর যিকিরের গুরুত্ব তুলে ধরে। এখানে বান্দা ও স্রষ্টার মধ্যে একটি চমৎকার পারস্পরিক সম্পর্কের চিত্র ফুটে উঠেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই স্মরণ বা যিকির কেবল মৌখিক উচ্চারণের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এর তিনটি প্রধান দিক রয়েছে:
১. জিহ্বার যিকির: তাসবীহ (সুবহানাল্লাহ), তাহলীল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ), তাকবীর (আল্লাহু আকবার) ও তাহমীদ (আলহামদুলিল্লাহ) পাঠ করা। পাশাপাশি কুরআন তেলাওয়াত, দু’আ ও ইস্তিগফারও এর অন্তর্ভুক্ত।
২. অন্তরের যিকির: আল্লাহর সৃষ্টি, তাঁর মহত্ত্ব ও অগণিত নেয়ামত নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করা। তাঁর প্রতি ভয় ও ভালোবাসা পোষণ করা এবং প্রতিটি কাজে তাঁর উপস্থিতি অনুভব করা।
৩. কর্মের যিকির: সালাত, সাওম, হজ্ব, যাকাতের মতো ফরজ ও নফল ইবাদত সঠিকভাবে পালন করা। প্রখ্যাত তাবেঈ সাঈদ ইবনে জুবাইর (রহ.)-এর মতে, আল্লাহর প্রকৃত স্মরণকারী তিনিই, যিনি তাঁর আনুগত্য করেন। আনুগত্যহীন ইবাদত প্রকৃত যিকির হিসেবে গণ্য হয় না।
এর প্রতিদানে আল্লাহ বান্দাকে যেভাবে স্মরণ করেন, তা এক বিশাল পুরস্কার। সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহ তাআলা বলেন, “বান্দা যদি আমাকে কোনো সমাবেশে স্মরণ করে, আমি তাকে তার চেয়ে উত্তম সমাবেশে (ফেরেশতাদের মাঝে) স্মরণ করি।” আল্লাহর এই স্মরণের অর্থ হলো বান্দার প্রতি তাঁর রহমত, ক্ষমা ও অনুগ্রহ বর্ষণ করা এবং বিপদ-আপদে তাকে সাহায্য করা।
কৃতজ্ঞতা: নেয়ামত বৃদ্ধি ও শাস্তিমুক্তির উপায়
আয়াতের দ্বিতীয় নির্দেশনাটি হলো কৃতজ্ঞতা প্রকাশ বা শোকর আদায় করা এবং অকৃতজ্ঞতা পরিহার করা। শোকর আদায়েরও তিনটি প্রধান ভিত্তি রয়েছে:
- অন্তরের মাধ্যমে: সকল নেয়ামত আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে—এই বিশ্বাস দৃঢ়ভাবে অন্তরে ধারণ করা।
- জিহ্বার মাধ্যমে: মুখে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে আল্লাহর প্রশংসা করা।
- কর্মের মাধ্যমে: আল্লাহর দেওয়া নেয়ামতকে তাঁর সন্তুষ্টির পথে ব্যয় করা। যেমন—স্বাস্থ্যকে ইবাদতে, জ্ঞানকে দ্বীনের প্রচারে এবং সম্পদকে হালাল পথে ব্যয় করা।
অন্যদিকে, ‘কুফর’ বা অকৃতজ্ঞতা হলো নেয়ামতকে অস্বীকার করা বা তার অপব্যবহার করা। আল্লাহ প্রদত্ত শক্তি দিয়ে পাপ করা কিংবা সম্পদকে হারাম পথে ব্যয় করা নেয়ামতের চরম অকৃতজ্ঞতা।
এ প্রসঙ্গে সূরা ইব্রাহিমের ৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তাআলা সুস্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন: “যদি তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার করো, তবে আমি অবশ্যই তোমাদেরকে আরও বাড়িয়ে দেবো। আর যদি অকৃতজ্ঞ হও, তবে নিশ্চয়ই আমার শাস্তি অত্যন্ত কঠোর।”
সুতরাং, সূরা বাকারার এই আয়াতটি মুমিনদের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। আল্লাহর স্মরণ ইবাদতের প্রাণশক্তি জোগায়, আর কৃতজ্ঞতা সেই ইবাদতের ফলস্বরূপ আল্লাহর নেয়ামতকে কেবল স্থায়ীই করে না, বরং তা বহুগুণে বৃদ্ধি করে।



