আবাসিক গ্যাস: পাইপলাইন তুলে দিয়ে সিলিন্ডার চালুর সিদ্ধান্তে উদ্বেগজন নিরাপত্তা উপেক্ষা করে বেসরকারি কোম্পানির হাতে বাজার ছাড়ার আশঙ্কা

মোঃ ইকবাল হোসেন সরদার: দীর্ঘদিন ধরে দেশের আবাসিক খাত পাইপলাইন গ্যাসের সুবিধার ওপর নির্ভরশীল থাকলেও সম্প্রতি সেই ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়েছে সরকার। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার এক ঘোষণায় জানানো হয়েছে, আবাসিক সংযোগে পাইপলাইনের ব্যবহার বন্ধ করে সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহারে উৎসাহিত করা হবে। সরকারের পক্ষ থেকে যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছে, আমদানি করা গ্যাসের পেছনে প্রতি ইউনিটে ৬০ থেকে ৬৫ টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে, যা অব্যাহত রাখা কঠিন। তাই শিল্প ও কারখানায় নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করতে আবাসিক খাতকে পাইপলাইন থেকে সরিয়ে আনার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
তবে সরকারের এই সিদ্ধান্তে জনমনে তীব্র প্রতিক্রিয়া ও প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। সাধারণ মানুষের মূল বক্তব্য হলো, তারা ভর্তুকি চান না; বরং গ্যাসের বাস্তবসম্মত মূল্য পরিশোধ করতে প্রস্তুত। কিন্তু কয়েক দশক ধরে ধরে চলা একটি নিরাপদ ব্যবস্থা বাতিল করে কেন তাদের সিলিন্ডারের মতো ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবস্থার দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে?
বাড়তি ঝুঁকি ও নিরাপত্তার প্রশ্ন
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিটি রান্নাঘরে গ্যাস সিলিন্ডার স্থাপন একটি বড় ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করবে। সামান্য অসতর্কতা, নিম্নমানের রেগুলেটর বা ত্রুটিপূর্ণ সিলিন্ডারের কারণে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের আশঙ্কা থাকে, যা প্রায়ই ঘটছে। শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত প্রতিটি বাড়িতে নিরাপত্তা মানদণ্ড নিশ্চিত করা কার্যত অসম্ভব। জনগণের আশঙ্কা, এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বহুগুণে বাড়বে এবং সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হবে নিম্নআয়ের মানুষ।
বাজার নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা কার হাতে?
এই নীতির পেছনের মূল উদ্দেশ্য নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সিলিন্ডারে যে গ্যাস সরবরাহ করা হবে, তার উৎস কী? যদি দেশের সরকারি গ্যাসক্ষেত্র থেকেই গ্যাস নিয়ে বেসরকারি কোম্পানিগুলো সিলিন্ডারে ভরে বিক্রি করে, তবে জনগণ কেন সরাসরি পাইপলাইনে সেই গ্যাস পাবে না? আর যদি বিদেশ থেকে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) আমদানি করা হয়, তবে এর মূল্য নির্ধারণের ক্ষমতা পুরোপুরি বেসরকারি কোম্পানিগুলোর নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে।
এর ফলে সরকার গ্যাসের বাজারের ওপর তার নীতিগত নিয়ন্ত্রণ হারাবে। এমনিতেই প্রায়শই দেখা যায়, সিলিন্ডার কোম্পানিগুলো নিজেদের ইচ্ছেমতো দাম বাড়িয়ে দেয় এবং সরকারি তদারকির অভাবে সাধারণ মানুষ জিম্মি হয়ে পড়ে। পুরো দেশকে সিলিন্ডার নির্ভর করা হলে এই সংকট আরও ভয়াবহ রূপ নেবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
জনগণের দাবি ও প্রস্তাবনা
এই পরিস্থিতিতে সাধারণ জনগণ ও বিশেষজ্ঞরা একটি টেকসই ও জনবান্ধব নীতির দাবি জানাচ্ছেন। তাদের প্রস্তাব হলো:
- সরকার একটি স্বচ্ছ ও স্থায়ী গ্যাস ব্যবস্থাপনা নীতি গ্রহণ করুক।
- ভর্তুকি প্রত্যাহার করে পাইপলাইনের মাধ্যমে বাস্তবমূল্যে জনগণকে গ্যাস সরবরাহ করা হোক।
- গ্যাসের দাম, নিরাপত্তা ও বিতরণ ব্যবস্থায় সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি নিশ্চিত করা হোক।
সাধারণ মানুষের বক্তব্য পরিষ্কার—তারা সরকারি কোষাগারে অর্থ দিতে প্রস্তুত, কিন্তু কোনো মুনাফালোভী বেসরকারি কোম্পানির হাতে জিম্মি হতে রাজি নন। এই প্রেক্ষাপটে, গ্যাস পাইপলাইন বন্ধ করে সিলিন্ডার চালুর পরিকল্পনাটি জনস্বার্থের পরিপন্থী এবং এটি জনগণের জীবনে ঝুঁকি ও দুর্ভোগের এক নতুন অধ্যায় সূচনা করতে পারে। সরকারের উচিত, জনগণের উদ্বেগ আমলে নিয়ে এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা।



