তাওয়াক্কুল ও কর্মবিমুখতা: বিশ্বাসের সঠিক প্রয়োগ ও ভুল ধারণার পার্থক্য
ইসলামিক বিচিত্রা ডেস্ক: “আল্লাহর উপর ভরসা রাখো” বা “তাওয়াক্কুল করো”—ইসলামের এই মৌলিক শিক্ষাটি প্রায়শই আমাদের সমাজে ভুলভাবে উপস্থাপিত হয়। অনেক সময় এই গভীর আধ্যাত্মিক ধারণাটিকে ব্যক্তিগত অলসতা বা কর্মবিমুখতার আবরণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়, যা ইসলামের মূল শিক্ষার পরিপন্থী। পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি না নিয়ে ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দেওয়া কিংবা চাকরির জন্য যথাযথ চেষ্টা না করে রিযিকের দোহাই দেওয়া—এগুলো তাওয়াক্কুল নয়, বরং দীর্ঘসূত্রিতা।
তাওয়াক্কুলের প্রকৃত অর্থ
ইসলামে তাওয়াক্কুল হলো দুটি পর্বের একটি সমন্বিত প্রক্রিয়া। এর প্রথম পর্ব হলো—নিজের সাধ্য অনুযায়ী সর্বোচ্চ চেষ্টা, পরিকল্পনা ও পরিশ্রম করা। দ্বিতীয় পর্ব হলো—সেই চেষ্টার পর ফলাফলের জন্য মহান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও নির্ভরতা স্থাপন করা। অর্থাৎ, চূড়ান্ত ফলাফল আল্লাহর হাতে—এই বিশ্বাস রেখে শান্ত থাকা। চেষ্টার অংশটি বাদ দিয়ে শুধু ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করাকে ইসলাম তাওয়াক্কুল হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না।
নবীজি (সা.)-এর শিক্ষা: উট এবং তাওয়াক্কুল
তাওয়াক্কুলের সঠিক রূপ কেমন হওয়া উচিত, তার সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর একটি বিখ্যাত হাদিসে। একবার তিনি এক বেদুইনকে দেখলেন, যে তার উটটিকে না বেঁধেই মসজিদে প্রবেশ করছিল। নবীজি (সা.) তাকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে লোকটি উত্তর দেয়, “আমি আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করেছি।” প্রত্যুত্তরে রাসুলুল্লাহ (সা.) সেই বিখ্যাত উক্তিটি করেন: “আগে তোমার উটটি বাঁধো, তারপর আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করো।”
এই হাদিসটি অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে প্রমাণ করে যে, জাগতিক উপায় বা উপকরণ গ্রহণ করা এবং নিজের দায়িত্ব পালন করা তাওয়াক্কুলের পূর্বশর্ত।
কর্মবিমুখতা বনাম তাওয়াক্কুল: একটি স্পষ্ট পার্থক্য
অলসতা বা কর্মে দীর্ঘসূত্রিতা (Procrastination) হলো কোনো কাজকে অকারণে বিলম্বিত করা বা ফেলে রাখা। যখন কোনো ব্যক্তি এই কর্মবিমুখতাকে “আল্লাহর ইচ্ছা” বলে চালিয়ে দিতে চান, তখনই বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়।
উদাহরণস্বরূপ, একজন চাকরিপ্রার্থীর জন্য তাওয়াক্কুল হলো—চাকরির জন্য প্রয়োজনীয় গবেষণা করা, নিজের যোগ্যতা বৃদ্ধি করা, জীবনবৃত্তান্ত তৈরি করা এবং পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে সাক্ষাৎকারে অংশ নেওয়া। এরপর ফলাফলের জন্য আল্লাহর ওপর ভরসা রাখা। কিন্তু কোনো প্রকার প্রস্তুতি না নিয়ে শুধু ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দেওয়া অলসতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
সর্বোত্তম আদর্শ: হিজরতের ঘটনা
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের ঘটনাটি পরিকল্পনা ও তাওয়াক্কুলের এক নিখুঁত সমন্বয়। তিনি কেবল “আল্লাহ রক্ষা করবেন” বলে বেরিয়ে পড়েননি। বরং তিনি রাতের অন্ধকারে যাত্রার সিদ্ধান্ত নেন, শত্রুদের বিভ্রান্ত করতে হযরত আলী (রা.)-কে নিজের বিছানায় শুইয়ে রাখেন, একজন অভিজ্ঞ পথপ্রদর্শক নিয়োগ করেন, সাওর পর্বতের গুহায় তিন দিন আত্মগোপন করেন এবং সেখানে খাবার ও পানীয়ের ব্যবস্থা নিশ্চিত করেন। এই সর্বোচ্চ মানবিক চেষ্টা ও নিখুঁত পরিকল্পনার পরই তিনি বাকিটা আল্লাহর ওপর সোপর্দ করেছিলেন।
সুতরাং, ইসলাম আমাদের শিক্ষা দেয় যে, তাওয়াক্কুল কর্মবিমুখতা নয়, বরং এটি মুমিনের কর্মপ্রেরণা। এটি আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে উৎসাহিত করে এবং ফলাফলের দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত রেখে মানসিক প্রশান্তি দান করে।
আমিন, ইয়া রাব্বিল আলামিন।



