ইসলাম ধর্ম

আত্মশুদ্ধি ও ক্ষমা লাভের উপায়: ইস্তিগফারের গুরুত্ব, ফজিলত ও পদ্ধতি

ইসলামিক বিচিত্রা ডেস্ক:

মানুষ হিসেবে আমরা প্রতিনিয়ত ভুল করি। এই ভুল বা পাপ থেকে ক্ষমা লাভের জন্য ইসলামে অত্যন্ত সুন্দর একটি বিধান হলো ‘ইস্তিগফার’ বা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা। এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত আরও একটি পরিভাষা হলো ‘তাওবা’, যার অর্থ আল্লাহর পথে ফিরে আসা। এই দুটি আমলের মাধ্যমে একজন মুমিন আত্মশুদ্ধি অর্জন করে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে পারে।

ইস্তিগফারের ফজিলত ও গুরুত্ব

কুরআনের আলোকে:
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা ক্ষমা প্রার্থনার প্রতি বিশেষভাবে উৎসাহিত করেছেন এবং এর পুরস্কারের কথাও উল্লেখ করেছেন।

  • আল্লাহর নির্দেশ: ‘তোমরা তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো, নিশ্চয়ই তিনি মহাক্ষমাশীল।’ (সূরা নূহ, আয়াত: ১০)
  • নবীকে (সা.) নির্দেশনা: ‘অতঃপর তোমার রবের প্রশংসাসহ পবিত্রতা বর্ণনা করো এবং তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো।’ (সূরা নাসর, আয়াত: ৩)
  • আজাব থেকে মুক্তি: ইস্তিগফার আল্লাহর শাস্তি থেকে রক্ষা পাওয়ার একটি অন্যতম মাধ্যম। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ তাদের শাস্তি দেবেন না, যখন তারা ইস্তিগফার করে (ক্ষমা প্রার্থনা করে)।’ (সূরা আনফাল, আয়াত: ৩৩)

তাওবার গুরুত্ব:
তাওবা অর্থ হলো কৃত ভুলের জন্য লজ্জিত হয়ে সেই পথ থেকে ফিরে আসা এবং ভবিষ্যতে তা না করার দৃঢ় সংকল্প করা।

  • আল্লাহর ভালোবাসা লাভ: ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা তাওবাকারীদের ও পবিত্রতা অর্জনকারীদের ভালোবাসেন।’ (সূরা বাকারা, আয়াত: ২২২)
  • রাসূলের (সা.) আমল: রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘হে মানব সকল! তোমরা আল্লাহর দিকে ফিরে আসো (তাওবা করো), নিশ্চয় আমি প্রতিদিন ১০০ বার তাওবা করি।’ (সহীহ মুসলিম)

যেভাবে ইস্তিগফার করবেন: ফজিলতপূর্ণ ৫টি দোয়া

ইস্তিগফার যেকোনো সময় sincer তার সাথে করা যায়। তবে রাসূলুল্লাহ (সা.) থেকে বর্ণিত কিছু দোয়া রয়েছে, যা পাঠ করা অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ।

১. সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত ইস্তিগফার

  • আরবি: أَسْتَغْفِرُ اللهَ
  • উচ্চারণ: আস্তাগফিরুল্লাহ।
  • অনুবাদ: আমি আল্লাহর ক্ষমা প্রার্থনা করছি।
  • ফজিলত: রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রত্যেক ফরজ নামাজের সালাম ফেরানোর পর এই দোয়াটি তিনবার পড়তেন। [মিশকাত: ৯৬১]

২. তাওবাসহ ইস্তিগফার

  • আরবি: أَسْتَغْفِرُ اللهَ وَأَتُوْبُ إِلَيْهِ
  • উচ্চারণ: আস্তাগফিরুল্লা-হা ওয়া আতূবু ইলাইহি।
  • অনুবাদ: আমি আল্লাহর ক্ষমা প্রার্থনা করছি ও তাঁর দিকে ফিরে আসছি।
  • ফজিলত: রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রতিদিন ৭০ বারের বেশি তাওবা ও ইস্তিগফার করতেন। [সহীহ বুখারী: ৬৩০৭]

৩. যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়নের মতো পাপ মোচনকারী দোয়া

  • আরবি: أَسْتَغْفِرُ اللَّهَ الَّذِي لاَ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ الْحَىُّ الْقَيُّومُ وَأَتُوبُ إِلَيْهِ
  • উচ্চারণ: আসতাগফিরুল্লা-হাল্লাযী লা ইলা-হা ইল্লা হুয়াল হাইয়্যুল কাইয়্যূম ওয়া আতূবু ইলাইহি।
  • অনুবাদ: আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই, তিনি ছাড়া কোনো সত্য উপাস্য নেই, তিনি চিরঞ্জীব, চিরস্থায়ী এবং তাঁর কাছেই তাওবা করি।
  • ফজিলত: এই দোয়া পাঠ করলে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেবেন, যদিও সে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়নকারী হয়। [আবু দাউদ: ১৫১৭, তিরমিযী: ৩৫৭৭]

৪. রাসূল (সা.)-এর পঠিত একটি বিশেষ দোয়া

  • আরবি: رَبِّ اغْفِرْ لِيْ وَتُبْ عَلَيَّ إِنَّكَ أَنْتَ التَّوَّابُ الرَّحِيْمُ
  • উচ্চারণ: রাব্বিগফির লী, ওয়া তুব ‘আলাইয়্যা, ইন্নাকা আনতাত তাওয়াবুর রাহীম।
  • অনুবাদ: হে আমার প্রভু, আপনি আমাকে ক্ষমা করুন এবং আমার তাওবা কবুল করুন। নিশ্চয়ই আপনি মহান তাওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু।
  • ফজিলت: রাসূলুল্লাহ (সা.) মসজিদে একই বৈঠকে এই দোয়াটি ১০০ বার পাঠ করেছেন। [আবু দাউদ: ১৫১৬, তিরমিযী: ৩৪৩৪]

৫. সাইয়্যেদুল ইস্তিগফার (ক্ষমা প্রার্থনার শ্রেষ্ঠ দোয়া)
এটি ইস্তিগফারের শ্রেষ্ঠ দোয়া এবং সকাল-সন্ধ্যার জিকিরের অন্তর্ভুক্ত।

  • আরবি: اللَّهُمَّ أَنْتَ رَبِّي لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ خَلَقْتَنِي وَأَنَا عَبْدُكَ وَأَنَا عَلَى عَهْدِكَ وَوَعْدِكَ مَا اسْتَطَعْتُ أَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ مَا صَنَعْتُ أَبُوءُ لَكَ بِنِعْمَتِكَ عَلَيَّ وَأَبُوءُ لَكَ بِذَنْبِي فَاغْفِرْ لِي فَإِنَّهُ لَا يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلَّا أَنْتَ
  • উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা আনতা রাব্বী, লা ইলা-হা ইল্লা আনতা, খালাকতানী ওয়া আনা ‘আবদুকা, ওয়া আনা ‘আলা ‘আহদিকা ওয়া ওয়া‘দিকা মাসতাতা‘তু। আ‘ঊযুবিকা মিন শাররি মা সানা‘তু, আবূউ লাকা বিনি‘মাতিকা ‘আলাইয়্যা, ওয়া আবূউ লাকা বিযাম্বী, ফাগফির লী, ফাইন্নাহূ লা ইয়াগফিরুয যুনূবা ইল্লা আনতা।
  • অনুবাদ: হে আল্লাহ! তুমিই আমার প্রতিপালক, তুমি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। তুমি আমাকে সৃষ্টি করেছ এবং আমি তোমার বান্দা। আমি আমার সাধ্যমতো তোমার সঙ্গে কৃত অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতির ওপর প্রতিষ্ঠিত আছি। আমি আমার কৃতকর্মের অনিষ্ট থেকে তোমার আশ্রয় চাই। আমার ওপর তোমার প্রদত্ত নিয়ামতের স্বীকৃতি দিচ্ছি এবং আমার পাপের কথাও স্বীকার করছি। অতএব, তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও, কেননা তুমি ছাড়া আর কেউ গুনাহ ক্ষমা করতে পারে না।
  • ফজিলত: যে ব্যক্তি দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে সকালে এই দোয়া পড়বে এবং সন্ধ্যার আগে মৃত্যুবরণ করবে, সে জান্নাতি হবে। আর যে ব্যক্তি সন্ধ্যায় পড়বে এবং সকালের আগে মৃত্যুবরণ করবে, সেও জান্নাতি হবে। [সহীহ বুখারী: ৬৩০৬]

মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে বেশি বেশি তাওবা ও ইস্তিগফার করার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি অর্জন করার তৌফিক দান করুন, আমিন।

বিশেষ দ্রষ্টব্য: আরবি একটি স্বতন্ত্র ভাষারীতি অনুসরণ করে, যার সঠিক উচ্চারণ বাংলায় লেখা সম্ভব নয়। তাই শুদ্ধ উচ্চারণের জন্য অভিজ্ঞ কোনো আলেমের নিকট থেকে দোয়াগুলো শিখে নেওয়া আবশ্যক।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button