অপরাধদেশপ্রতারনাসংগৃহীত সংবাদ

অকল্পনীয় লাভের ফাঁদ: সরলতার সুযোগ নাকি লোভের বলি?

অপরাধ বিচিত্রা ডেস্ক: “লাখ টাকায় মাসে ৪ হাজার টাকা লাভ!”—শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও, এমন চটকদার বিজ্ঞাপনের ফাঁদে পা দিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন হাজারো মানুষ। সম্প্রতি দেশজুড়ে গজিয়ে ওঠা নামসর্বস্ব, অনুমোদনহীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এমন অবাস্তব লাভের লোভ দেখিয়ে সাধারণ মানুষের কষ্টার্জিত সঞ্চয় হাতিয়ে নিচ্ছে। ভুক্তভোগীরা নিজেদের ‘সহজ-সরল’ এবং ‘প্রতারিত’ বলে দাবি করলেও প্রশ্ন উঠছে—এটি কি কেবলই সরলতার সুযোগ নেওয়া, নাকি অতি লোভের করুণ পরিণতি?

ঘটনার সূত্রপাত হয় একটি অবিশ্বাস্য প্রস্তাব দিয়ে। কোনো এক বেনামি প্রতিষ্ঠান থেকে যখন প্রতি লাখে মাসিক চার হাজার টাকা লাভের ঘোষণা আসে, তখন স্বাভাবিকভাবেই অনেকের মনে সন্দেহ জাগে। কিন্তু সেই সন্দেহকে ছাপিয়ে যায় দ্রুত ধনী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা। ভুক্তভোগীদের ভাষ্যমতে, প্রক্রিয়াটি শুরু হয় স্বল্প পরিমাণ বিনিয়োগ দিয়ে। উদাহরণস্বরূপ, একজন ব্যক্তি প্রথমে এক লাখ টাকা জমা রাখেন। প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় মাসে ঠিক সময়েই প্রতিশ্রুত চার হাজার টাকা মুনাফা পেয়ে তার আস্থা বহুগুণে বেড়ে যায়।

এই প্রাথমিক সাফল্যই কাল হয়ে দাঁড়ায়। বিনিয়োগকারী ভাবতে শুরু করেন, এটি তার ভাগ্য বদলের একটি সুবর্ণ সুযোগ। ফলে, নিজের কাছে থাকা এবং অন্যান্য উৎস থেকে আনা সব মিলিয়ে বিশাল অঙ্কের টাকা—ধরা যাক ১০ লাখ টাকা—বিনিয়োগ করেন। পরের মাসগুলোতে সময়মতো ৪০ হাজার টাকা করে লাভ আসতে থাকলে তার আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে ওঠে। ‘বিনা পরিশ্রমে স্বয়ংক্রিয় আয়’—এই ধারণায় বিভোর হয়ে ওঠেন তিনি।

কিন্তু এই স্বস্তির মেয়াদ দীর্ঘ হয় না। কয়েক মাস যেতেই হঠাৎ একদিন দেখা যায়, সেই প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়ে তালা ঝুলছে। কর্মকর্তাদের ফোন বন্ধ, কারও কোনো খোঁজ নেই। ঠিক তখনই বিনিয়োগকারীর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। জীবনের সমস্ত সঞ্চয় হারিয়ে তার আর্তনাদ করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।

প্রতারণার শিকার হওয়ার পর শুরু হয় নতুন বিড়ম্বনা। টাকা উদ্ধারের আশায় বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তি বা ‘দালাল’ শ্রেণীর মানুষের দ্বারস্থ হন ভুক্তভোগীরা। এই সুযোগে একদল ধুরন্ধর লোক ‘টাকা তুলে দেওয়ার’ কথা বলে তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন অজুহাতে দফায় দফায় মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিতে থাকে। ছয় মাস বা এক বছর পর দেখা যায়, আসল টাকা তো ফেরত মেলেইনি, উল্টো উদ্ধারের নামে আরও লক্ষাধিক টাকা খোয়া গেছে।

শেষ চেষ্টা হিসেবে অনেকে থানা-পুলিশ ও আদালতের শরণাপন্ন হন। কিন্তু সেখানেও মামলা ও উকিলের খরচ চালাতে গিয়ে নতুন করে আর্থিক চাপে পড়েন। দিনের পর দিন আদালতের বারান্দায় ঘুরে সময় ও শ্রম নষ্ট হয়, কিন্তু মূলধন উদ্ধারের বিষয়টি অনিশ্চিতই থেকে যায়।

এই ঘটনা কোনো একক ব্যক্তির নয়। সারা দেশে এমন হাজারো ভুক্তভোগী রয়েছেন, যারা নিজেদের কষ্টার্জিত লাখ লাখ, এমনকি কোটি টাকাও খুইয়েছেন। প্রতারকরা নিঃসন্দেহে চতুর এবং তারা মানুষের সহজ বিশ্বাস ও দ্রুত ধনী হওয়ার লোভকে পুঁজি করেই তাদের জাল বিস্তার করে।

কিন্তু মূল প্রশ্নটি হলো, বিনিয়োগকারীরা কি সত্যিই কেবলই প্রতারিত, নাকি নিজের লোভের ফাঁদে নিজেরাই ধরা দিয়েছেন? যে প্রস্তাবটি শুরু থেকেই অবাস্তব এবং অসম্ভব বলে মনে হয়, সেটিকে বিশ্বাস করার দায় কার? অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, লোভ মানুষের বিচার-বুদ্ধি এবং যুক্তিবোধকে অসাড় করে দেয়।

বর্তমান সময়ে, যেখানে প্রতারণার কৌশল প্রতিনিয়ত পাল্টাচ্ছে, সেখানে নিজের সঞ্চয় রক্ষা করার একমাত্র উপায় হলো সচেতনতা। যেকোনো চটকদার ও অবাস্তব প্রস্তাবে প্রলুব্ধ হওয়ার আগে নিজেকে প্রশ্ন করা জরুরি। কারণ, অবিশ্বাস্য লাভের পেছনে ছুটলে, যা আছে তা-ও হারানোর ঝুঁকি শতভাগ।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button