এক হিন্দু নারীর সম্ভ্রম এবং সম্রাটের মুকুট: মুঘল ন্যায়বিচারের এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়
অপরাধ বিচিত্রা ডেস্ক: মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের न्यायবিচারের কথা ইতিহাসজুড়ে সুবিদিত। তার সেই বিখ্যাত ‘ন্যায়বিচারের ঘণ্টা’ ছিল যেকোনো সাধারণ প্রজার জন্য সম্রাটের কাছে সরাসরি অভিযোগ পৌঁছানোর এক বিশ্বস্ত মাধ্যম। তবে তার শাসনকালের এক ঘটনা শুধু ন্যায়বিচারকেই নয়, বরং শাসকের দায়বদ্ধতা এবং মানবিকতাকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল, যেখানে এক হিন্দু নারীর সম্ভ্রম সম্রাটের মুকুটের চেয়েও মূল্যবান হয়ে উঠেছিল।
ঘটনার সূত্রপাত দরবারে এক বয়স্ক হিন্দু নারীর আগমন দিয়ে। অশ্রুসিক্ত চোখে তিনি সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছে অভিযোগ করে বলেন, “জাহাঁপনা, আমার পুত্র আপনার সেনাবাহিনীতে দেশসেবায় রত। কিন্তু তার অনুপস্থিতিতে প্রতি রাতে এক দুষ্কৃতকারী আমার গৃহে প্রবেশ করে আমার পুত্রবধূর সম্ভ্রমহানির চেষ্টা করে। আমি আপনার কাছে আমার কন্যার সম্মান রক্ষার জন্য বিচার চাইতে এসেছি।”
বৃদ্ধার অভিযোগ শুনে সম্রাট জাহাঙ্গীর কোনো তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে নীরব রইলেন। সম্রাটের এই নীরবতায় ক্ষুব্ধ ও হতাশ হয়ে সেই নির্ভীক নারী বলে ওঠেন, “জাহাঙ্গীর, আমি তোমার বেড়ে ওঠা দেখেছি। যদি তুমি আমার পুত্রবধূর সতীত্ব রক্ষা করতে না পারো, তবে শেষ বিচারের দিনে আমি তোমার স্রষ্টার আদালতে তোমাকে আসামি হিসেবে দাঁড় করাব। আমাকে হয় न्याय দাও, নতুবা দুই দিনের সময় দাও, আমি তোমার রাজ্য ছেড়ে চলে যাব।”
এমন কঠোর কথা শুনেও সম্রাট অবিচল রইলেন। ভগ্ন হৃদয়ে সেই বৃদ্ধা বাড়ি ফিরে গেলেন।
কিন্তু সেই রাতেই ঘটনার মোড় ঘুরে যায়। সম্রাট জাহাঙ্গীর ছদ্মবেশে, হাতে খোলা তরবারি নিয়ে亲自 সেই বৃদ্ধার বাড়ির কাছে গিয়ে হাজির হন। গভীর অন্ধকারে তিনি দেখলেন, বাড়ির দরজায় একজন প্রহরী দাঁড়িয়ে আছে এবং ভেতর থেকে এক নারীর আর্তনাদ ভেসে আসছে— “বাঁচাও, বাঁচাও!”
এক মুহূর্ত দেরি না করে সম্রাট প্রহরীকে হত্যা করে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করেন। সেখানে থাকা দুর্বৃত্তকে জাপটে ধরে তিনি বৃদ্ধাকে আদেশ দেন, “আলো নিভিয়ে দিন।” বৃদ্ধা আলো নেভানোর সঙ্গে সঙ্গেই সম্রাট জাহাঙ্গীর এক কোপে সেই দুষ্কৃতকারীর শিরশ্ছেদ করেন। এরপর তিনি পুনরায় আদেশ দেন, “এবার আলো জ্বালান।”
আলো জ্বলে ওঠার পর সম্রাট ঝুঁকে পড়ে মৃত ব্যক্তির মুখ দেখেন এবং স্বস্তির নিঃশ্বাসে বলে ওঠেন, “আলহামদুলিল্লাহ!” এরপর তিনি বৃদ্ধার কাছে পানি চেয়ে পান করেন এবং বলেন, “আগামীকাল আপনার পুত্রবধূকে নিয়ে দরবারে হাজির হবেন।”
পরদিন রাজদরবার লোকে লোকারণ্য। সম্রাট সেই বৃদ্ধাকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কি জানেন, আমি কেন আপনাকে আলো নেভাতে বলেছিলাম?” বৃদ্ধা ‘না’ সূচক উত্তর দিলে সম্রাট ব্যাখ্যা করলেন, “আমার আশঙ্কা ছিল, রাজধানীর এত কাছে আমার প্রাসাদের সন্নিকটে এমন দুঃসাহস আমার পুত্র ছাড়া আর কারও পক্ষে দেখানো সম্ভব নয়। আমি যদি আমার পুত্রের মুখ দেখে ফেলতাম, তবে পিতার স্নেহ হয়তো বিচারের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারত। न्यायবিচারে দুর্বলতা আসতে পারে, এই ভয়ে আমি অন্ধকারে তাকে হত্যা করি। কিন্তু আলো জ্বালানোর পর যখন দেখলাম সে আমার পুত্র নয়, তখন স্বস্তিতে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেছিলাম।”
এরপর তিনি পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কি জানেন, আমি কেন আপনার ঘরে পানি পান করেছিলাম?” বৃদ্ধা আবারও ‘না’ বললে জাহাঙ্গীর বলেন, “যেদিন আপনি আমাকে শেষ বিচারের দিনে আল্লাহর কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর কথা বলেছিলেন, সেদিন থেকে এই ঘটনার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আমি এক ফোঁটা পানি বা এক দানা খাবারও গ্রহণ করিনি। প্রচণ্ড দুশ্চিন্তায় ছিলাম যে, আমি কি আদৌ সঠিক न्याय প্রতিষ্ঠা করতে পারব? আপনার সম্ভ্রম রক্ষা করার পরেই আমি দুশ্চিন্তামুক্ত হয়ে আপনার ঘরে পানি পান করি।”
সবশেষে, সম্রাট জাহাঙ্গীর নিজের মাথা থেকে শাহী ‘মুকুট’ খুলে সেই হিন্দু বৃদ্ধার পায়ের কাছে রেখে বলেন—
“মনে রাখবেন, একজন মুসলমান শাসকের কাছে তার হিন্দু প্রজাকন্যার সম্ভ্রম, সম্রাটের মাথার মুকুটের চেয়েও অনেক বেশি দামী।”
এই ঐতিহাসিক ঘটনাটি শুধু একটি বিচ্ছিন্ন উদাহরণ নয়, বরং এটি সেই আদর্শের প্রতিফলন যার ওপর ভিত্তি করে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। জোর-জবরদস্তি, অপমান বা সংঘাতের মাধ্যমে নয়, ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সব ধর্মের মানুষের নিরাপত্তা, সম্মান এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার মাধ্যমে। মানুষের প্রতি শাসকের ভালোবাসা, সততা এবং দায়বদ্ধতাই ছিল মুসলিম শাসকদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের মূল ভিত্তি।



