দাম্পত্য সম্পর্কের রূপরেখা: সূরা নিসার আলোকে স্বামী ও স্ত্রীর দায়িত্ব ও অধিকার

ইসলামিক বিচিত্রা ডেস্ক: ইসলামে পরিবার একটি মৌলিক প্রতিষ্ঠান এবং এর ভিত্তি হলো স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক। পবিত্র কুরআনের সূরা আন-নিসার ৩৪ নম্বর আয়াতে এই সম্পর্কের রূপরেখা, উভয়ের অধিকার এবং পারস্পরিক দায়িত্ব সম্পর্কে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এই আয়াতটি পারিবারিক জীবনে পুরুষের কর্তৃত্ব এবং নারীর ভূমিকা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে, যা মুসলিম সমাজের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ বিধান।
কুরআনের বাণী: আয়াত ও অর্থ
আয়াত:
اَلرِّجَالُ قَوّٰمُوْنَ عَلَى النِّسَآءِ بِمَا فَضَّلَ اللّٰهُ بَعْضَهُمْ عَلٰى بَعْضٍ وَّ بِمَاۤ اَنْفَقُوْا مِنْ اَمْوَالِهِمْ١ؕ فَالصّٰلِحٰتُ قٰنِتٰتٌ حٰفِظٰتٌ لِّلْغَیْبِ بِمَا حَفِظَ اللّٰهُ١ؕ وَ الّٰتِیْ تَخَافُوْنَ نُشُوْزَهُنَّ فَعِظُوْهُنَّ وَ اهْجُرُوْهُنَّ فِی الْمَضَاجِعِ وَ اضْرِبُوْهُنَّ١ۚ فَاِنْ اَطَعْنَكُمْ فَلَا تَبْغُوْا عَلَیْهِنَّ سَبِیْلًا١ؕ اِنَّ اللّٰهَ كَانَ عَلِیًّا كَبِیْرًا
অর্থ: “পুরুষরা নারীদের ওপর কর্তৃত্বশীল (কর্তা)। কারণ আল্লাহ তাদের একজনকে অন্যজনের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন এবং যেহেতু পুরুষ নিজের সম্পদ থেকে ব্যয় করে। সুতরাং পুণ্যবতী স্ত্রীরা অনুগত হয় এবং স্বামীর অনুপস্থিতিতে আল্লাহর হেফাজতে তার অধিকারসমূহ সংরক্ষণ করে। আর যেসব স্ত্রীর অবাধ্যতার আশঙ্কা কর, তাদের সদুপদেশ দাও, শয্যা থেকে পৃথক কর এবং (প্রয়োজনে) শাসন কর। অতঃপর যদি তারা তোমাদের অনুগত হয়ে যায়, তবে তাদের ওপর নির্যাতনের কোনো পথ খুঁজো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ মহান ও সর্বশ্রেষ্ঠ।”
তাফসির ও ব্যাখ্যা: পুরুষের কর্তৃত্ব ও দায়িত্ব
এই আয়াতে পুরুষকে নারীর ‘কাওয়াম’ বা কর্তা বলা হয়েছে, যার অর্থ নেতা, তত্ত্বাবধায়ক ও রক্ষক। তাফসিরকারকদের মতে, এই কর্তৃত্বের দুটি প্রধান কারণ রয়েছে:
১. আল্লাহ প্রদত্ত শ্রেষ্ঠত্ব: আল্লাহ তায়ালা প্রাকৃতিকভাবে পুরুষকে কিছু ক্ষেত্রে নারীর চেয়ে অধিক সক্ষমতা দিয়েছেন, যা নেতৃত্ব ও ব্যবস্থাপনার জন্য অপরিহার্য। একারণেই নবুয়ত, খিলাফত এবং বিচারকার্যের মতো গুরুদায়িত্ব পুরুষদের ওপর অর্পণ করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “সেই জাতি কখনো সফলকাম হবে না, যারা কোনো নারীকে তাদের শাসক বানায়।” (সহীহ বুখারী)
২. আর্থিক দায়বদ্ধতা: ইসলামে পরিবারের সম্পূর্ণ আর্থিক দায়িত্ব, যেমন—মোহরানা, ভরণপোষণ এবং অন্যান্য যাবতীয় খরচ বহন করা পুরুষের ওপর বাধ্যতামূলক। এই অর্থনৈতিক দায়বদ্ধতাও তাকে পারিবারিক নেতৃত্বে superior করেছে।
পুণ্যবতী স্ত্রীর গুণাবলি
- আনুগত্য (قٰنِتٰتٌ): তারা স্বামীর প্রতি অনুগত থাকে এবং ইসলামের সীমার মধ্যে থেকে স্বামীর নির্দেশনা মেনে চলে।
- বিশ্বস্ততা (حٰفِظٰتٌ لِّلْغَیْبِ): স্বামীর অনুপস্থিতিতে নিজের সতীত্ব এবং স্বামীর সম্পদ ও সম্মানের হেফাজত করে।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “উত্তম স্ত্রী সে-ই, যার দিকে তাকালে স্বামী সন্তুষ্ট হয়, কোনো নির্দেশ দিলে তা পালন করে এবং স্বামীর অনুপস্থিতিতে নিজের সম্মান ও স্বামীর সম্পদ রক্ষা করে।” অন্য এক হাদিসে এসেছে, যে নারী পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে, রমজানের রোজা রাখে, নিজের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে এবং স্বামীর আনুগত্য করে, তাকে বলা হবে—জান্নাতের যেকোনো দরজা দিয়ে ইচ্ছা প্রবেশ করো।
দাম্পত্য জীবনে অবাধ্যতা দেখা দিলে করণীয়
যদি কোনো স্ত্রীর মধ্যে অবাধ্যতা বা উচ্ছৃঙ্খলতার (نشوز) আশঙ্কা দেখা দেয়, তবে ইসলাম পর্যায়ক্রমে তিনটি পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছে:
১. সদুপদেশ: প্রথমে তাকে ভালোবাসা ও নম্রতার সাথে বোঝাতে হবে, আল্লাহর ভয় প্রদর্শন করতে হবে এবং স্বামীর অধিকার সম্পর্কে স্মরণ করিয়ে দিতে হবে।
২. শয্যা পৃথকীকরণ: এতেও সংশোধন না হলে তার শয্যা পৃথক করে দিতে হবে। এটি একটি মনস্তাত্ত্বিক চাপ, যা সম্পর্ক সংশোধনে ভূমিকা রাখতে পারে।
৩. শাসন বা মৃদু প্রহার: এরপরও সংশোধন না হলে শেষ উপায় হিসেবে তাকে মৃদু শাসন করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে বিদায় হজের ভাষণে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এমনভাবে শাসন করা যাবে না, যা গুরুতর হয় বা শরীরে কোনো চিহ্ন ফেলে দেয়। হাদিসে আল্লাহর দাসীদের প্রহার করতে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে, “যারা স্ত্রীদের ওপর শক্তি প্রয়োগ করে, তারা তোমাদের মধ্যে উত্তম নয়।”
স্ত্রীর অধিকার ও চূড়ান্ত সতর্কবার্তা
স্বামীকে যেমন আনুগত্য লাভের অধিকার দেওয়া হয়েছে, তেমনি স্ত্রীর অধিকারের বিষয়েও কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে স্ত্রীর অধিকার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, “তুমি যখন খাবে, তাকেও খাওয়াবে; তুমি যখন পরবে, তাকেও পরাবে। তার মুখে কখনো আঘাত করবে না এবং তাকে ঘর থেকে বের করে দেবে না।”
আয়াতের শেষে আল্লাহ তায়ালা সতর্ক করে বলেন, স্ত্রীরা অনুগত হয়ে গেলে তাদের ওপর আর কোনো কঠোরতা আরোপ করা যাবে না। যদি কেউ অন্যায়ভাবে স্ত্রীর ওপর জুলুম করে, তবে তাকে মনে রাখতে হবে, “আল্লাহ মহান ও সর্বশ্রেষ্ঠ।” অর্থাৎ, মজলুমের পক্ষে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট।
(উৎস: তাফসীর ইবনে কাসীর)



