
এম শাহীন আলম: যুগের পর যুগ স্বাস্থ্য নীতির তোয়াক্কা না করে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ (কুমেক) হাসপাতালের প্রধান সহকারী ও আওয়ামী দোসর খ্যাত দেলোয়ার হোসেন দলীয় প্রভাব আর ক্ষমতার ছত্রছায়ায় একের পর এক অনিয়ম-দুর্নীতি চালিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের আশীর্বাদে তিনি গড়ে তুলেছেন এক দুর্নীতির সাম্রাজ্য।
দলীয় ছত্রছায়ায় অনিয়মের সাম্রাজ্য
সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯২ সালে কুমেক হাসপাতালে ক্যাশিয়ার হিসেবে চাকরি শুরু করা দেলোয়ার হোসেন পরে ২০১৪ সালে চাকরি বিধি লঙ্ঘন করে বেআইনিভাবে প্রধান সহকারী পদে পদোন্নতি পান। অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় সংসদ সদস্য আ ক ম বাহার উদ্দিন বাহারের আশীর্বাদে তিনি দীর্ঘ ২২ বছর ধরে একটানা একই হাসপাতালে চাকরি করছেন, যা সরকারি বিধি পরিপন্থী।
এই দীর্ঘ সময়ে দেলোয়ার হাসপাতালের প্রশাসনিক ও আর্থিক কর্মকাণ্ডে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেন। ক্যাশিয়ার, হিসাবরক্ষক ও প্রধান সহকারী—এই তিনটি পদ তিনি নিজ নিয়ন্ত্রণে রেখে নানা ভুয়া বিল-ভাউচারের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

কোটি টাকার সম্পদ, বেতন দিয়ে অযৌক্তিক
সরজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, দেলোয়ার হোসেনের বেতন ও সরকারি সুবিধার সঙ্গে তার সম্পদের কোনো সামঞ্জস্য নেই। শরীয়তপুরের নিজ গ্রাম ও কুমিল্লার চাপাপুরে রয়েছে তার বিপুল পরিমাণ জমি ও ফ্ল্যাট। এছাড়া কুমিল্লা দুদক কার্যালয়ের দক্ষিণ পাশে তার ৬ তলা বিশিষ্ট বিলাসবহুল ভবন রয়েছে, যার ২৪টি ইউনিটের মালিকানা তার পরিবারের নামে রয়েছে বলে নিশ্চিত সূত্র জানিয়েছে।
এছাড়াও কুমিল্লা শহর ও আশপাশের এলাকায় একাধিক ফ্ল্যাট ও প্লট রয়েছে বলে জানা গেছে। হাসপাতালের কর্মচারী ও স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন—দেলোয়ার তার ঘনিষ্ঠদের মাধ্যমে এই সম্পদ বেনামে ক্রয় করেছেন।
দুদক তদন্ত ও প্রশাসনিক উদাসীনতা
বিগত সময়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) দেলোয়ারের বিরুদ্ধে একাধিকবার অভিযোগ উঠলেও কোনো দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, তিনি আওয়ামী দলীয় প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় থেকে তদন্ত প্রভাবিত করেছেন।
২০১৯ সালের ১৭ নভেম্বর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) ডা. মো. বেলাল হোসেন স্বাক্ষরিত এক প্রতিবেদনে দেলোয়ারের বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া যায়। পরে ২০২০ সালের ১ মার্চ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তাকে স্ট্যান্ড রিলিজ করে চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে বদলি দেয়। কিন্তু দেলোয়ার প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে মামলা করে ওই আদেশ স্থগিত করেন এবং কুমেকে বহাল থাকেন।
ঘুষ-দালালি ও সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ
অনুসন্ধানে জানা যায়, হাসপাতালের ইউপি চেয়ারম্যান মামুনুর রশিদ মামুন ও স্থানীয় একদল আওয়ামীপন্থি কর্মীর সহায়তায় দেলোয়ার গড়ে তুলেছেন এক “দুর্নীতির সিন্ডিকেট”। আউটসোর্সিং কর্মী নিয়োগ, ঠিকাদারি বিল, দোকান ভাড়া ও ওষুধ সরবরাহ—সব কিছুতেই চলছে তাদের ভাগ-বাটোয়ারা।
হাসপাতালের ভিতরে একটির অনুমোদন থাকা সত্ত্বেও তিনটি ওষুধের দোকান চলছে অবৈধভাবে, যা দেলোয়ারের যোগসাজশেই পরিচালিত হচ্ছে বলে জানা যায়।
পরিবারের নামে সম্পদ ও পরিচয় জালিয়াতি
আরও জানা যায়, দেলোয়ার হোসেন তার স্ত্রী মাহমুদা আক্তার এবং পরিবারের সদস্যদের নামে বিপুল পরিমাণ সম্পদ গড়েছেন। অভিযোগ আছে, ২০০৭ সালে মাহমুদা আক্তার নামের একজন সিনিয়র নার্সকে নিজের স্ত্রী পরিচয় দিয়ে কুমিল্লা ফয়জুন্নেসা সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে তার মেয়েকে ভর্তি করান। নামের মিল ব্যবহার করে এভাবেও অনিয়মের আশ্রয় নেন তিনি।
প্রশাসনের নীরবতা ও অদৃশ্য শক্তির আশ্রয়
বিগত ২০২০ সালে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের উপসচিব জাকিয়া পারভীন কুমেক হাসপাতালের পরিচালককে চিঠি দিয়ে দেলোয়ারের বিরুদ্ধে বিভাগীয় বা ফৌজদারি মামলা করার নির্দেশ দেন। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবের ভয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর দেশের প্রশাসনে ব্যাপক পরিবর্তন এলেও দেলোয়ার এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছেন। সচেতন মহলের প্রশ্ন—কোন অদৃশ্য শক্তির জোরে তিনি এত বছর ধরে এই অনিয়মের পরও টিকে আছেন?
অনুসন্ধান অব্যাহত
দেলোয়ার হোসেনের অনিয়মের খবর প্রকাশের পর থেকে তিনি বিভিন্ন সাংবাদিক ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মাধ্যমে সংবাদ না ছাপানোর জন্য তদবির করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
বর্তমানে তার বিরুদ্ধে নতুন করে তদন্ত চলছে। সংশ্লিষ্ট মহল মনে করছে—যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের সুনাম ও সেবা উভয়ই হুমকির মুখে পড়বে।
জনগণের অর্থে পরিচালিত কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল দুর্নীতির আখড়া হয়ে উঠেছে কিছু অসাধু কর্মকর্তার কারণে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতি আহ্বান—দেলোয়ার হোসেনের অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে দ্রুত তদন্ত সম্পন্ন করে যথাযথ প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।



