
শেয়ার করুনমোহাম্মদ হুমায়ুন কবির: প্রবীণ সাংবাদিক নেতাদের কথিত ‘অলৌকিক হাতের ছোঁয়ায়’ একদল অপসাংবাদিকের আবির্ভাব ঘটেছে। এদের কর্মকাণ্ড ও কথাবার্তায় পেশাদার সাংবাদিকদের সুনাম ক্ষুণ্ণ হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
গণমাধ্যমকর্মীরা অবগত আছেন যে, একটি জাতীয় পত্রিকা বা টেলিভিশন চ্যানেলে সংবাদ প্রকাশের ক্ষমতা ও দায়িত্ব মূলত বার্তা সম্পাদক ও সম্পাদকের ওপরই বর্তায়। একজন প্রতিবেদকের কাজ শুধু সংবাদ সংগ্রহ ও পাঠানো, কিন্তু সেই সংবাদ প্রকাশিত হবে কি না, তা প্রাথমিকভাবে বার্তা সম্পাদক এবং পরবর্তীতে সম্পাদকের অনুমতির ওপর নির্ভর করে। অথচ তথাকথিত অপসাংবাদিকরা এই মৌলিক বিষয়গুলো সম্পর্কে অবগত না হয়েও নিজেদের সাংবাদিক ও সাংবাদিক নেতা হিসেবে পরিচয় দিচ্ছেন।
একটি সংবাদ লেখার ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা, নৈতিকতা ও বিবেকবোধ অত্যন্ত জরুরি। সঠিক তথ্য যাচাই, নির্ভুল উপস্থাপন এবং ভাষার শুদ্ধতা একজন সাংবাদিকের পেশাগত দক্ষতার প্রতিফলন। একজন প্রকৃত সাংবাদিক ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে, বিভিন্ন দফতরে ছুটে সংবাদ সংগ্রহ করেন। দিনভর কঠোর পরিশ্রমের পর লেখা জমা দিয়ে পরদিন সকালে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন তার সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছে কি না, তা দেখার জন্য। এভাবে নানান ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে তিনি একজন সাংবাদিক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। কিন্তু বর্তমানে এমন এক প্রবণতা দেখা যাচ্ছে যেখানে কোনো লেখালেখি ছাড়াই অনেকে সাংবাদিক বনে যাচ্ছেন। এর কারণ হিসেবে অভিজ্ঞ সাংবাদিকরা কিছু প্রবীণ সাংবাদিক নেতার ‘অতি প্রশ্রয়’কেই দায়ী করছেন।
এই ‘অলৌকিক হাতের ছোঁয়ায়’ জন্ম নেওয়া অপসাংবাদিকরা সংবাদ লেখার সংজ্ঞা জানেন না, অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের কৌশল বোঝেন না, সংবাদ সংগ্রহ বা লিখতে পারেন না, এমনকি কোনোদিন কোনো পত্রিকা অফিসে ডেস্কে বসে এক কলমও লেখেননি। অথচ তারা শুধু সাংবাদিক পরিচয় দেন না, সাংবাদিক নেতা হওয়ার জন্য কালবৈশাখী ঝড়ের মতো ছুটে বেড়ান। তাদের এই অদ্ভুত মনোভাবের রহস্য কী? কিছু না জেনেও, কিছু না লিখেও কেন তারা সাংবাদিক পরিচয় এবং নেতা হতে চান? আর আমরা যারা পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে ৫, ১০ বা ২০-৩০ বছর ধরে সাংবাদিকতা করছি, যাদের পবিত্র ভোটে ইউনিয়ন এবং বিএফইউজে-এর নেতাদের নির্বাচিত করেছি, তারাও কেন এই অপকর্মীদের নেতা হওয়ার জন্য উৎসাহিত করছেন?
আমি আমার লেখার মাধ্যমে সংশ্লিষ্টদের প্রতি বিনীত অনুরোধ করছি, দয়া করে অসাংবাদিকদের সাংবাদিক বা সাংবাদিক নেতা হওয়ার সুযোগ আর দিবেন না। কারণ এদের জন্যই একজন পেশাদার সাংবাদিক সাংবাদিক সমাজে তার সঠিক সম্মানটুকু পাচ্ছেন না। একজন পেশাদার সাংবাদিক স্বপ্ন দেখেন একদিন তিনি প্রধান প্রতিবেদক হবেন, বার্তা সম্পাদক হবেন, সম্পাদক হবেন, এবং পরবর্তীতে ইউনিয়ন, বিএফইউজে বা জাতীয় প্রেসক্লাবের মহাসচিব ও সভাপতি পদে আসীন হবেন। কিন্তু অসাংবাদিকদের নেতা বা সাংবাদিক বানালে পেশাদার সাংবাদিকদের মানহানি করা হয়।
যারা ‘জি হুজুর, জি হুজুর’ করে, চামচামি করে, আজ একজনের সুনাম করে আবার কাল আরেকজনের বদনাম করে নেতাদের সান্নিধ্যে নিজেদের জড়িয়ে রাখে, তাদের তুলনা করা যেতে পারে পতিতাবৃত্তির সাথে। তাদের স্বার্থ উদ্ধার হয়ে গেলে আপনাকে ফেলে দিতে তারা বিন্দুমাত্র দ্বিধা করবে না। কারণ তাদের কোনো চাকরির সুযোগ নেই, লেখার অভিজ্ঞতা নেই, সম্পাদক বা প্রকাশক হওয়ার যোগ্যতা বা আর্থিক সামর্থ্য নেই। ঘরে বাইরে বসার মতো কোনো স্থান নেই, পরিবারের কাছেও তারা বেকার হিসেবে গঞ্জনা শুনতে শুনতে ক্লান্ত। এমন পরিস্থিতিতে তাদের কাছে একটাই সুযোগ থাকে—সাংবাদিক নেতা হয়ে রাজনৈতিক ও সরকারি দফতরে ফায়দা লোটা। যার ফলস্বরূপ তারা আরও দু-চারজন অলস সঙ্গী নিয়ে সারাদিন নেতাদের আশেপাশে লেগে থাকে এবং ক্লাবের বাইরে সাংবাদিক পরিচয়ে দাপিয়ে বেড়ায়।
সাংবাদিকতা কোনো সন্ত্রাসী বা ভূমিদখল বা রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রদর্শনের মাধ্যম নয়। সাংবাদিকদের কাজ হলো রাষ্ট্র ও জনগণের পক্ষে জনকল্যাণমুখী কাজে বিবেক খাটিয়ে, লোভকে সামলে, স্থির থেকে সংবাদ প্রকাশ করা। যারা সাংবাদিক হতে চান, তাদের উচিত নিয়মিত প্রথম সারির পত্রিকার লেখার ধরন পর্যবেক্ষণ করা, সাংবাদিকতার বইপত্র পড়া এবং সিনিয়রদের সহযোগিতায় কোনো পত্রিকা অফিসে বসে কাজ শিখে নেওয়া। তা না করে সারাদিন চাঁদাবাজি ও ধান্দা করে, নেতাদের ঘন ঘন সালাম দিয়ে, পা টিপে টিপে চামচামি করে পদ দখল করলে হয়তো সাময়িকভাবে চলতে পারবেন। কিন্তু বয়স বাড়লে কেউ আপনাকে জিজ্ঞাসা করবে না। সাংবাদিক জীবন শিক্ষা, সততা ও বিবেকের উপর নির্ভরশীল। সাংবাদিকের চাকরি সকালে থাকে তো বিকেলে নেই, কিন্তু সাংবাদিকতায় শিক্ষা থাকলে, লিখতে জানলে, সততা থাকলে বিপদে পড়লে মানুষ আপনাকে সাহায্য করবে। আর নেতারা আপনাকে যুবতী মেয়েদের মতো এখন ভালোবাসলেও, সময় ফুরিয়ে গেলে আর কাছে ডাকবে না। তখন আপনার উপায় হবে কি? কীভাবে জীবন নির্বাহ করবেন? ক্লাবে আসতে হলেও তো টাকা লাগবে, পাবেন কোথায়?



