ইসলাম ধর্ম

ইসলামের নামে নারীবিদ্বেষ নয়, নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য চাই যথার্থ ইসলামী জ্ঞান ও অধিকারের সমতা

ইসলামিক বিচিত্রা ডেস্ক: ইসলাম একটি ভারসাম্যপূর্ণ জীবনবিধান, যা নারী ও পুরুষ উভয়কে সম্মান ও অধিকার দিয়েছে। অথচ সমাজে প্রায়শই দেখা যায়, ইসলামের নামে নারীর পর্দার ওপর জোর দেওয়া হলেও পুরুষের পর্দার বিষয়টি উপেক্ষিত থাকে। এটি ইসলামের মূল শিক্ষার পরিপন্থী, যা নারীবিদ্বেষ ছড়াতে সহায়ক হয়। এই প্রতিবেদনে নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা, বিশেষত পর্দার বিধান এবং নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় পুরুষদের দায়িত্ব সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

পুরুষের পর্দা ও ছতরের গুরুত্ব:
আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে বলেন, “মুমিন পুরুষদের বলো, তারা তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখবে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করবে। এটাই তাদের জন্য অধিক পবিত্র।” (সূরা নূর: ৩০)। এই আয়াত স্পষ্ট নির্দেশ করে যে পুরুষের জন্যেও দৃষ্টির সংযম ও ছতরের হেফাজত ফরজ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, অনেক সময় ইসলামের প্রচারক দাবিদাররাও এই বিষয়ে উদাসীন থাকেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় ফুটবল তারকাদের ছতর ভঙ্গ করা ছবি বা হাঁটুর ওপরে পোশাক পরিধান করে চলাফেরা করা, যা নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য দৃষ্টিকটু, তা অনেকের কাছে স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

গ্রামাঞ্চলে আজও দেবর-ভাবী বা চাচাতো-মামাতো ভাইবোনের মধ্যে পর্দার প্রয়োজনীয়তা উপেক্ষিত হয়। লুঙ্গি পরে খালি গায়ে গল্প করার মতো বিষয়গুলো পুরুষের চোখের পর্দা ও ছতর সম্পর্কে অজ্ঞতা বা উদাসীনতার ফল।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও নৈতিক অবক্ষয়:
সহশিক্ষা ইসলামে হারাম হলেও, শুধু মেয়েদের জন্য নির্ধারিত বিদ্যালয় ও কলেজগুলোতেও নৈতিক অবক্ষয় কম নয়। ২৫ বছরের কম বয়সী পুরুষ শিক্ষকদের দ্বারা ছাত্রীরা প্রেমের ফাঁদে পড়ছে, প্রতারিত বা ব্ল্যাকমেইলের শিকার হচ্ছে। এর একটি কারণ হলো অভিভাবকদের ব্যর্থতা; তারা মেয়েদেরকে শিক্ষাগত যোগ্যতার মূল্য শেখাতে পারলেও, তাদের ইজ্জত ও সম্মানের মূল্য যে সর্বাধিক, তা শেখাতে পারেননি। এমনকি একজন মসজিদের ইমাম তার সাবালিকা মেয়ের জন্য মুসলিম নারী শিক্ষক থাকা সত্ত্বেও হিন্দু পুরুষ গৃহশিক্ষক রেখেছিলেন, এই আশঙ্কায় যে কোনো মুসলিম যুবকের সাথে মেয়েটি সম্পর্কে জড়িয়ে পড়তে পারে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। বহু শিক্ষার্থী ভালো ফলাফলের লোভে শিক্ষকদের অনৈতিক ফাঁদে পা দেয়।

মহিলা মাদ্রাসাগুলোতেও পুরুষ শিক্ষকদের আধিপত্য দেখা যায়, যেখানে পর্দার নিয়মাবলী ঠিকমতো মানা হয় না। এর ফলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনৈতিক সম্পর্কের ঘটনা ঘটছে। এই মাদ্রাসাগুলোতে তাওহীদ, আল্লাহর সিফাত, তাগুত, আল-ওয়ালা ওয়াল-বারা (আল্লাহর জন্য ভালোবাসা ও তাঁর শত্রুদের থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করা), আসাবিয়াত (জাতিগত বা গোত্রীয় শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা) এবং আহলে বায়াত (নবী পরিবারের সদস্য) সম্পর্কিত মৌলিক আলোচনা প্রায় অনুপস্থিত থাকে। ফলে মোটিভেশনাল বক্তারা সহজেই মাদ্রাসা খোলার সুযোগ পান, কারণ সরকার অনুমোদিত শিক্ষাব্যবস্থা তাওহীদের পরিপূর্ণ আলোচনার অনুমোদন দেয় না।

সরকারের ভূমিকা ও এনজিওদের প্রভাব:
পথশিশুদের নিয়ে দ্বীনি শিক্ষা চালু করার প্রচেষ্টা বহু বাধার মুখে বন্ধ করে দিতে হয়। কারণ সরকার গরিব শিশুদের শিক্ষার নামে বিদেশি অর্থ আনে এবং এনজিওগুলোকে সেই কাজের অনুমোদন দেয়। এনজিওগুলো তাদের এজেন্ডা অনুযায়ী শির্ক, কুফরী ও সমকামিতার শিক্ষা দেয়, যা ইসলামের মূল শিক্ষার পরিপন্থী। এমনও দেখা গেছে, একজন এমপি বা মন্ত্রী এই ধরনের প্রকল্পের প্রধান পরিচালক হতে চেয়েছেন এবং শিক্ষাব্যবস্থা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে নিজেদের জনপ্রিয়তা বাড়াতে বা নির্বাচনে প্রচারের কাজে লাগাতে চেয়েছেন।

সরকার ইংরেজি ও প্রযুক্তির শিক্ষায় কোনো সমস্যা দেখে না, কিন্তু দ্বীনি শিক্ষার ক্ষেত্রে তারা অনুমোদনের সীমা নির্ধারণ করে দেয়। স্কুল-কলেজে ইসলাম শিক্ষা রাখা হয় যেন বোঝানো যায় তারা ধর্মবিরোধী নয়, কিন্তু তাওহীদের মৌলিক শিক্ষা থেকে জাতিকে দূরে রাখা হয়। কারণ তাওহীদ জানলে মানুষ তাদের মুনাফেকী কর্মকাণ্ডকে ঘৃণা করবে।

নারীর স্মার্টফোন ও পুরুষের দায়িত্ব:
অনেক বক্তা ও আলেম নারীর স্মার্টফোন ব্যবহার ও অনলাইন উপস্থিতির বিরোধিতা করেন, অথচ তাদের স্ত্রী ও ভক্তরাই অনলাইনে অধিক সক্রিয় থাকেন। অন্ধ ভক্তরা মোটিভেশনাল বক্তব্য শুনে নিজেকে দ্বীনদার মনে করলেও, ফিরকা, আহলে বায়াত, আল-ওয়ালা ওয়াল-বারা এবং খলিফার কোরাইশি হওয়ার মতো মৌলিক বিষয়ে তাদের সঠিক ধারণা নেই।

এটা ঠিক যে নারীর তাকওয়া না থাকলে অনলাইন থেকে দূরে থাকা উচিত, কিন্তু দ্বীন শেখার জন্য অনলাইন এখন অপরিহার্য যখন অধিকাংশ প্রচলিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তাগুতের নিয়ন্ত্রণে। তবে স্মার্টফোন শুধু নারীর জন্যই বিপদজনক নয়, পুরুষের জন্যও সমানভাবে বিপদজনক। নারী ও পুরুষ উভয়েই অনলাইনে প্রেম ও পরকীয়ায় জড়াচ্ছে। এখানে নারী-পুরুষ উভয়েই দোষী। মুমিন পুরুষ কীভাবে একজন মুসলিম ভাইয়ের স্ত্রীর সাথে অনৈতিক সম্পর্কে জড়াতে পারে?

ধর্ষণ ও নারীর অধিকার:
ধর্ষণের ঘটনা ঘটলে অনেক সময় নারীকে দোষারোপ করা হয়, যা অত্যন্ত অমানবিক। শরীয়া আইনের অভাবে জালেমরা শিশু ও নাবালিকাদের ধর্ষণ করলেও অনেকে শুধু নারীর পর্দার অজুহাত খোঁজে। সমাজে ধর্ষিতাকে সহানুভূতি বা আশ্রয় দিতে কেউ রাজি হয় না, বিয়ে তো দূরের কথা। এমনকি নারী বান্ধবীরাও ধর্ষিতার সাথে মিশতে চায় না, অথচ তারাই নিজেদের জীবনে প্রেম-পরকীয়ায় লিপ্ত থাকে। অন্যদিকে, ৪-৫টি প্রেম করা সুন্দরী বা তারকা নারীকে বিয়ে করতে বহু পুরুষ রাজি হয়। আবার অনেক নারী একজন সৎ, দ্বীনদার ও গরিব মুমিনের স্ত্রী হতে চায় না, কিন্তু জনপ্রিয়, ধনী বা আলেমের দ্বিতীয় স্ত্রী হতে আপত্তি করে না; কারণ তাদের জীবনযাপন ও জনপ্রিয়তা তাদের আকর্ষণ করে।

দায়িত্বশীলতার অভাব ও ভোগবাদ:
রাসূল (সা.)-এর শ্রেষ্ঠ দাঈ মুসাইব বিন উমায়ের (রা.) ইসলাম গ্রহণের পূর্বে বিলাসী জীবনযাপন করলেও ইসলাম গ্রহণের পর কঠোর মুজাহিদ ও শহীদ হিসেবে জীবন উৎসর্গ করেছেন। কিন্তু আজকের অনেক দাঈ ইসলামের ওয়াজ করে বিলাসী জীবন কাটাচ্ছেন। কারণ কিছু ওয়াজ করলে জনপ্রিয়তা ও অর্থ অর্জন সহজ, আর কিছু ওয়াজ (যেমন তাওহীদ ও তাগুতের বিরুদ্ধে) করলে চাকরিচ্যুতি, ব্যবসা বন্ধ এমনকি জেল-জুলুমের শিকার হতে হয়, যা সাহাবিদের জীবনে ঘটেছিল।

অভিভাবকরা মেয়েদের ব্যাপারে কিছুটা সচেতন হলেও কিশোর ও তরুণদের অনলাইন ব্যবহারে উদাসীন। ফলে তারা বিভিন্ন গেম, কিশোর গ্যাং, মাদকাসক্তি, ছিনতাই ও ধর্ষণের মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। অনেক বক্তার বক্তব্যের কারণে নারী-পুরুষ পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস হারাচ্ছে। কোনো ঘটনা ঘটলেই পুরুষেরা বলে নারীরা জাহান্নামের সংখ্যাধিক্য হবে, আবার নারীরা পুরুষকে পথভ্রষ্ট বলে মন্তব্য করে, যা উভয়কেই একে অপরের প্রতি বিদ্বেষী করে তোলে।

নারীর আর্থিক অধিকার প্রতিষ্ঠা:
নারীবাদী হওয়া যেমন কাম্য নয়, তেমনি নারীবিদ্বেষী হওয়াও অনুচিত। নারীদের আজকের অধঃপতনের জন্য পুরুষরাও অনেকাংশে দায়ী। বহু পরহেজগার দাবিদাররা নারীর দেনমোহর বা সম্পত্তির অধিকার দিতে অস্বীকার করে। আল্লাহ তাআলা কোরআনে বলেন:
“আর যদি তোমরা আশঙ্কা কর যে, ইয়াতীম মেয়েদের প্রতি সুবিচার করতে পারবে না। তবে বিয়ে করবে নারীদের মধ্যে যাকে তোমাদের ভালো লাগে, দুই, তিন বা চার। আর যদি আশঙ্কা কর যে সুবিচার করতে পারবে না তবে একজনকেই বা তোমাদের অধিকারভুক্ত দাসীকেই গ্রহণ কর।” (সূরা নিসা: আয়াত ৩)
এই আয়াত বহু বিবাহের বৈধতা দিলেও, অনেক পুরুষ দেনমোহর ও সম্পদের অধিকার দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে নিজেদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে।

ছোটবেলায় অনেক মা-খালাদের দেনমোহর বা পৈতৃক সম্পত্তির হক্ব থেকে বঞ্চিত হতে দেখা গেছে। অথচ ভাই বা স্বজনরা জমি কিনে বিল্ডিং করেছেন বা ছেলেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন, কিন্তু বোন বা ফুফুদের প্রাপ্য দেননি। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “কারো এক বিঘত সম্পদ যদি কেউ আত্মসাৎ করে তাহলে কিয়ামতের ময়দানে আল্লাহ তার গলায় সাত স্তবক জমিন ঝুলিয়ে দেবেন এবং তাকে ধসাতে থাকবেন।”

পূর্বে অনেক পুরুষ সামান্য মনোমালিন্য হলে তালাকের হুমকি দিত, কিন্তু মোহরানা পূর্ণাঙ্গ পরিশোধ করত না। তারা যেন স্বামী নয়, সন্ত্রাসীর মতো শাসন করতে চাইত। অবশ্যই ভালো পুরুষ যেমন ছিল, তেমনই ভালো মা ও বোন আজও আছে এবং থাকবে।

নারীদের এই নির্মম জীবনযাপন দেখে অনেকে তাদের বোনদের উচ্চশিক্ষিত করে চাকরি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কিন্তু ইউরোপ-আমেরিকায় উচ্চপদে থাকা নারীরাও কর্মক্ষেত্রে নির্যাতনের অভিযোগ করেন। তাই ইসলামই একমাত্র সমাধান, যা দেনমোহর ও সম্পত্তির অধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে নারীদের জীবনে সম্মান ও শান্তি আনতে পারে। অনেককে বুঝিয়ে বিবাহের ৩০ বছর পরও দেনমোহর আদায় করা সম্ভব হয়েছে।

মোহরানা ও সম্পত্তির সঠিক বন্টন:
আল্লাহ তাআলা বলেন:
“বাবা-মা এবং আত্মীয় স্বজনের পরিত্যক্ত সম্পদে পুরুষের অংশ রয়েছে এবং বাব-মা ও আত্মীয় স্বজনের পরিত্যক্ত সম্পদে নারীরও অংশ রয়েছে, তা অল্পই হোক বা বেশি হোক, এক নির্ধারিত অংশ।” (সূরা নিসা: আয়াত ৭)
এই আয়াত অনুযায়ী, নারী ও পুরুষ উভয়েরই সম্পত্তিতে নির্ধারিত অংশ রয়েছে। বর্তমানে মোহরানার নামে ব্যবসা বা বাড়াবাড়ি বন্ধ করতে হবে।

উপসংহার:
মুমিন ভাই ও বোন উভয়ই উম্মাহর সম্পদ। নারী ও পুরুষ উভয়েরই পর্দা ফরজ, আর সবচেয়ে উত্তম পর্দা হলো তাকওয়া। একটি সমাজ ও উম্মাহকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে হলে নারী-পুরুষ উভয়কেই দ্বীনি শিক্ষা, তাকওয়া অর্জন এবং ইসলামী অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। নারীদের অধঃপতনের কারণ কেবল নারীরা একা নয়, বরং পুরুষদের ইসলাম না মানাও এর অন্যতম কারণ। ইসলাম কেবল কঠোরতা দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়নি, বরং ইনসাফ ও ভারসাম্যের সুপরিমিত মিশ্রণ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
সবশেষে, লেখার ভালো দিকগুলো গ্রহণ করুন এবং ভুলগুলো ধরিয়ে দিন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button