ইসলাম ধর্ম

হারাম উপার্জন: দুনিয়া ও আখিরাতের ধ্বংসের মূল

ইসলামিক বিচিত্রা ডেস্ক; ইসলামে হালাল উপার্জন কেবল একটি কর্তব্য নয়, বরং এটি মুমিনের ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং আধ্যাত্মিক উন্নতির সোপান। এর বিপরীতে, হারাম উপার্জন দুনিয়া ও আখিরাতের সকল কল্যাণ ও শান্তি হরণকারী এক ভয়াবহ কারণ। এটিকে আধ্যাত্মিক বিষতুল্য গণ্য করা হয়, যা ইবাদতসহ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিষক্রিয়া ঘটায়। নিচে হারাম উপার্জনের ভয়াবহতা বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো:

দুনিয়াতে হারাম উপার্জনের ভয়ংকর পরিণতি:

১. দোয়া ও ইবাদত কবুল না হওয়া:
রাসূলুল্লাহ (সা.) হারাম উপার্জন সম্পর্কে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। তিনি এমন এক ব্যক্তির কথা উল্লেখ করেছেন, যে দীর্ঘ সফরের ক্লান্তিতে উস্কো-খুস্কো চুল ও ধূলিধূসরিত শরীর নিয়ে আকাশের দিকে হাত তুলে আকুতি জানাচ্ছে, “হে আমার রব! হে আমার রব!” অথচ তার খাদ্য, পানীয়, পোশাক সবই হারাম এবং সে হারাম দ্বারাই পরিপুষ্ট। নবীজী প্রশ্ন করেছেন: “এমতাবস্থায় তার দোয়া কীভাবে কবুল হতে পারে?” (সহীহ মুসলিম: ১০১৫) এই হাদিস স্পষ্ট করে যে, হারাম উপার্জন ইবাদতের মূল ভিত্তিকেই অপবিত্র করে তোলে, ফলে সকল চেষ্টা বৃথা যায়। আল্লাহ পবিত্র, তাই তিনি কেবল পবিত্র জিনিসই গ্রহণ করেন।

২. সম্পদ ও রিজিকের বরকতহীনতা (অশান্তির আগুন):
হারাম উপার্জনের অন্যতম প্রধান লক্ষণ হলো, সেই সম্পদে কোনো প্রকার শান্তি বা বরকত না থাকা। উপার্জন প্রচুর হলেও তা কোনো কল্যাণ বয়ে আনে না। এটি যেন এক অদৃশ্য আগুন, যা টাকাকে দ্রুত পুড়িয়ে ফেলে। মানুষ অবিরাম অর্থ উপার্জন করেও অভাবী থেকে যায়, অসুস্থতা, মামলা-মোকদ্দমা বা অপ্রয়োজনীয় খাতে অর্থ ব্যয় হতে থাকে। আল্লাহ তাআলা সুদ সম্পর্কে বলেছেন: “আল্লাহ সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং সাদকাকে বাড়িয়ে দেন।” (সূরা বাকারা: ২৭৬)। অর্থাৎ, হারাম পথ সম্পদকে ধ্বংসের দিকে ধাবিত করে।

৩. কঠিন হৃদয়ের জন্ম:
হারাম খাদ্য ও সম্পদ গ্রহণ অন্তরকে কঠিন করে তোলে। এই কঠিন হৃদয়ে আল্লাহর ভয় বা ইবাদতের মিষ্টতা প্রবেশ করে না। ফলে পাপ কাজকে আর পাপ মনে হয় না। ধীরে ধীরে মানুষ আল্লাহর আনুগত্য থেকে দূরে সরে যায় এবং জাহান্নামের পথে এগিয়ে চলে।

৪. পারিবারিক অশান্তি:
হারাম উপার্জনে লালিত-পালিত পরিবারে শান্তি বিরাজ করে না। পিতা-মাতার হারাম রোজগারের কুফল সন্তানদের মাঝেও সংক্রমিত হয়, যা দাম্পত্য কলহ, সন্তানের অবাধ্যতা এবং সমাজে নানা প্রকার অশান্তি সৃষ্টি করতে পারে।

আখিরাতের (পরকালের) মর্মান্তিক শাস্তি:

১. জাহান্নামের জ্বালানি হওয়া:
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “যে দেহের গোশত হারাম দ্বারা গঠিত, তা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না, বরং জাহান্নামই তার জন্য উপযুক্ত।” (আহমাদ ১৪৪১)। অর্থাৎ, হারাম দ্বারা পরিপুষ্ট শরীর জান্নাতের সুঘ্রাণ থেকেও বঞ্চিত হবে এবং চিরস্থায়ী জাহান্নামের উপযুক্ত হবে।

২. কিয়ামতের দিন আল্লাহর অসন্তোষ:
হারাম উপার্জনকারীরা কিয়ামতের দিন আল্লাহর বিশেষ রহমত থেকে বঞ্চিত হবে। আল্লাহ তাদের দিকে তাকাবেন না, তাদের সাথে কথা বলবেন না এবং তাদের পাপ মোচন করে পবিত্রও করবেন না। তাদের জন্য অপেক্ষা করছে মর্মন্তুদ শাস্তি। (সূরা আলে ইমরান: ৭৭)

৩. যুদ্ধের ঘোষণা:
যারা সুদের মতো জঘন্য হারামে লিপ্ত হয়, আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, “যদি তোমরা তা (সুদ) না কর, তবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও…” (সূরা বাকারা: ২৭৯)। এর চেয়ে ভয়াবহ পরিণতি আর কী হতে পারে!

৪. নবীদের অভিশাপ:
ঘুষ, সুদ, ও অন্যান্য হারাম লেনদেনের সঙ্গে জড়িতদের প্রতি রাসূলুল্লাহ (সা.) কঠোর অভিশাপ দিয়েছেন। তিনি সুদদাতা, সুদগ্রহীতা, সুদের লেখক এবং এর সাক্ষীদের উপর অভিসম্পাত করেছেন এবং বলেছেন তারা সবাই সমান অপরাধী। (সহীহ মুসলিম: ৩৯৮৫)

মুক্তির পথ: তওবা এবং পবিত্রতা:

এই ভয়াবহ পরিণতি থেকে বাঁচার জন্য মুমিনের একমাত্র পথ হলো:

১. আন্তরিক তওবা: অবিলম্বে আল্লাহর কাছে নিজের সকল ভুলের জন্য তওবা করা।

২. তাৎক্ষণিক বর্জন: বর্তমানে যে হারাম উপার্জনের উৎস রয়েছে, তা অবিলম্বে ছেড়ে দেওয়া।

৩. সম্পদ পবিত্রকরণ: যদি জানা থাকে, কার সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রহণ করা হয়েছে, তবে তাকে তা ফিরিয়ে দেওয়া। যদি মালিককে খুঁজে পাওয়া না যায়, তবে সেই সম্পদ সওয়াবের আশা না করে জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করে দেওয়া। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে সম্পদকে সম্পূর্ণরূপে পবিত্র করা সম্ভব।

হারাম উপার্জন হলো ধ্বংসের বীজ বপন করা। এটি সাময়িক সুবিধা দিলেও তা ব্যক্তির ঈমান, ইবাদত, জীবন এবং আখিরাতকে স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে দেয়। একজন মুমিনের জীবনে অল্প হালাল উপার্জনই অঢেল হারামের চেয়ে অনেক বেশি উত্তম, কারণ এতেই রয়েছে আল্লাহর সন্তুষ্টি, শান্তি এবং চিরন্তন বরকত।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button