ইসলামে বহুবিবাহ: ‘ইনসাফ’ না থাকলে তা ‘নোংরামি’র নামান্তর!
ইসলামিক বিচিত্রা ডেস্ক: ইসলামি শরীয়াহ অনুসারে বহুবিবাহ শর্তসাপেক্ষ বৈধ হলেও, বাংলাদেশে এর অপব্যবহার নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। বিশেষ করে কিছু আলেম নামধারী ব্যক্তি কোরআনের মূল নির্দেশনা ‘ইনসাফ’কে উপেক্ষা করে স্বেচ্ছাচারিতা করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এতে ইসলামের পবিত্র বিধান প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে এবং সমাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বহুবিবাহকে ‘আবশ্যিক’ বা ‘সুন্নত’ হিসেবে না দেখে, বরং এর কঠোর শর্তগুলো পূরণ সাপেক্ষে এটিকে একটি বৈধতা হিসেবেই ইসলাম দেখে।
কোরআনের মূল নির্দেশনা: ‘সুবিচার করতে না পারলে একজনকেই বিয়ে করো’
পবিত্র কোরআনের সূরা নিসার ৩ নম্বর আয়াতে বহুবিবাহের বিধান সম্পর্কে বলা হয়েছে: “আর যদি তোমরা আশঙ্কা করো যে, ইয়াতীমদের প্রতি সুবিচার করতে পারবে না, তবে বিবাহ কর (স্বাধীন) নারীদের মধ্যে যাকে তোমাদের ভালো লাগে; দু’জন, তিনজন অথবা চারজন। আর যদি আশঙ্কা কর যে, সুবিচার করতে পারবে না, তবে একজনকে (বিবাহ কর)।” (সূরা নিসা, ৪:৩)
এই আয়াতে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে, সর্বোচ্চ চারজন নারীকে বিয়ে করা যেতে পারে, তবে শর্ত হলো ‘সুবিচার’ (ইনসাফ) করতে পারার নিশ্চয়তা থাকতে হবে। যদি সামান্যতমও আশঙ্কা থাকে যে সুবিচার করা সম্ভব হবে না, তবে একজনকেই বিয়ে করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বহুবিবাহে ‘ইনসাফ’-এর বিস্তৃত অর্থ
ইসলামি শরীয়াহ অনুযায়ী, ‘ইনসাফ’ শুধুমাত্র আর্থিক সমতা বা খাওয়া-পরার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি একটি ব্যাপক ও কঠিন শর্ত, যার আওতায় রয়েছে:
- রাত্রিযাপন ও সময়ের সমতা: সকল স্ত্রীর জন্য রাতে থাকার জন্য সমান সময় বরাদ্দ করা আবশ্যক।
- আর্থিক ও দৈহিক প্রয়োজন: বাসস্থান, খাদ্য, বস্ত্র ও অন্যান্য মৌলিক চাহিদার ক্ষেত্রে সমতা নিশ্চিত করা।
- আচরণগত সমতা: স্ত্রীদের সঙ্গে আচরণে এবং মনোযোগ দেওয়ায় সমতা বজায় রাখা।
ইসলামি বিদ্বানদের মতে, মানসিক ভালোবাসা বা হৃদয়ের টান বাদে অন্য সকল বিষয়ে ‘ইনসাফ’ করা ফরয (আবশ্যিক)। তবে আল্লাহ নিজেই সূরা নিসার ১২৯ নম্বর আয়াতে বলেছেন: “আর তোমরা কখনও স্ত্রীগণের মধ্যে সুবিচার করতে পারবে না, যদিও তোমরা তা কামনা করো। অতএব তোমরা (কোনো একজনের দিকে) সম্পূর্ণভাবে ঝুঁকে পড়ো না এবং অপরকে ঝুলন্ত অবস্থায় রেখো না…” (সূরা নিসা, ৪:১২৯)। এই আয়াত প্রমাণ করে যে একাধিক স্ত্রীর প্রতি পুরোপুরি সুবিচার করা মানুষের জন্য প্রায় অসম্ভব। এ কারণেই প্রথম আয়াতে আল্লাহ ‘একজনকে’ বিয়ে করার উপর জোর দিয়েছেন, যদি ইনসাফ করতে না পারার বিন্দুমাত্র আশঙ্কা থাকে।
‘নোংরামি’র রূপ ও অপব্যবহার:
বর্তমানে কিছু আলেম বা প্রভাবশালী ব্যক্তির মধ্যে এই ‘ইনসাফ’-এর শর্তকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে:
- প্রথম স্ত্রীকে ‘ঝুলিয়ে রাখা’: প্রথম স্ত্রীর ভরণপোষণ বা প্রাপ্য অধিকার নিশ্চিত না করে তাকে মানসিক ও সামাজিকভাবে অবহেলিত রেখে দ্বিতীয় বা তৃতীয় বিয়ে করা কোরআনের সরাসরি লঙ্ঘন।
- লোভ ও লালসার বশবর্তী: সমাজে প্রভাব বা ক্ষমতা প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে অথবা কেবল ব্যক্তিগত লালসা চরিতার্থ করতে বহুবিবাহকে ব্যবহার করা হচ্ছে, যার পেছনে নেই কোনো সামাজিক প্রয়োজন বা ইনসাফের চেষ্টা।
- বিবাহকে সহজীকরণ: তারা দ্বিতীয় বা তৃতীয় বিবাহকে এতটাই সহজভাবে উপস্থাপন করছেন যেন এটি একটি ফ্যাশন বা অধিকার, যা প্রথম স্ত্রীর প্রতি অন্যায় হলেও জায়েজ।
আহ্বান ও করণীয়:
ইসলাম বহুবিবাহকে শর্তসাপেক্ষে বৈধতা দিয়েছে সমাজে বিশেষ পরিস্থিতি (যেমন যুদ্ধ, নারীদের সংখ্যাধিক্য, প্রথম স্ত্রীর অক্ষমতা ইত্যাদি) মোকাবিলা করার জন্য, এটিকে স্বেচ্ছাচারিতা বা ‘বোঝা’ হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ হিসেবে নয়।
বাংলাদেশের আলেম সমাজ এবং মুসলিম সমাজের প্রতি বিনয়ের সাথে আহ্বান জানানো হচ্ছে:
১. বহুবিবাহের পূর্বে ‘ইনসাফ’-এর সকল শর্ত পূরণ করুন।
২. প্রথম স্ত্রীর যথাযথ অধিকার নিশ্চিত না করে দ্বিতীয় বিবাহ থেকে বিরত থাকুন।
৩. আলেম সমাজের উচিত ইসলামের সঠিক বার্তা তুলে ধরা এবং ‘ইনসাফ’কে তুচ্ছ না করা, কারণ তাদের কাছ থেকেই সাধারণ মানুষ শিক্ষা গ্রহণ করে।
ইনসাফ করতে পারলে বহুবিবাহ বৈধ, অন্যথায় একজনেই সন্তুষ্ট থাকা উচিত। মনে রাখতে হবে, পরকালে আল্লাহর কাছে প্রতিটি কর্মের জন্য কঠোর জবাবদিহি করতে হবে।



