ইসলাম ধর্ম

ইসলামী আন্দোলন বর্জন করে বাতিল দল অনুসরণের ভয়াবহ পরিণতি: হাশরের ময়দানে কঠিন বিপদ!

ইসলামিক বিচিত্রা ডেস্ক: ইসলামী জীবনদর্শনে আল্লাহ তায়ালার একত্ববাদ (তাওহীদ) এবং তাঁর প্রতি নিঃশর্ত ভালোবাসা মুমিনের ঈমানের মূল ভিত্তি। কুরআনুল কারীম ও হাদিসের অসংখ্য স্থানে এই তাওহীদের গুরুত্ব এবং শিরক ও বাতিল পথ অবলম্বনের ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে। বিশেষত, যারা ইসলামী আন্দোলনকে পাশ কাটিয়ে বাতিল দল বা মতাদর্শের অনুসরণ করে, কিয়ামতের দিন তাদের জন্য অপেক্ষা করছে এক কঠিন বিপদ। সূরা আল-বাক্বারার ১৬৫ থেকে ১৬৭ নং আয়াতে এই বিষয়টি অত্যন্ত স্পষ্ট করে তুলে ধরা হয়েছে।

আল-বাক্বারা, আয়াত নং: ১৬৫-১৬৭ এর ব্যাখ্যা:

১৬৫ নং আয়াত: শিরক ও আল্লাহর ভালোবাসার পার্থক্য
আল্লাহ তায়ালা ১৬৫ নং আয়াতে বলছেন যে, সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহর অসংখ্য সুস্পষ্ট নিদর্শন থাকা সত্ত্বেও কিছু মানুষ আল্লাহ ছাড়া অন্যদেরকে তাঁর সমকক্ষ বা প্রতিপক্ষ বানিয়ে নেয়। তারা তাদের এমনভাবে ভালোবাসে, যেমন ভালোবাসা একমাত্র আল্লাহ তায়ালার প্রাপ্য। অথচ সত্যিকারের ঈমানদারগণ আল্লাহকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন। আয়াতের শেষাংশে বলা হয়েছে, যদি এই জালেমরা আজই (দুনিয়াতে) আযাব দেখে যা বোঝার তা বুঝতো, তাহলে তারা উপলব্ধি করতো যে, সমস্ত শক্তি ও ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর অধীন এবং শাস্তি প্রদানে তিনি অত্যন্ত কঠোর।

তাফসীর: ইমাম বুখারী ও মুসলিমের হাদিসে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, সবচেয়ে বড় পাপ হলো আল্লাহর সাথে শিরক করা। মুমিনের অন্তর আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের বিশ্বাসে পরিপূর্ণ থাকে; তারা আল্লাহ ছাড়া আর কারও কাছে প্রার্থনা করে না, কারও সামনে মস্তক অবনত করে না। এই আয়াতে আল্লাহ সেইসব আত্ম-অত্যাচারী শিরককারীদের শাস্তির সংবাদ দিচ্ছেন। কিয়ামতের দিন তারা বুঝবে যে, একমাত্র আল্লাহই মহা ক্ষমতাবান এবং তাঁর শাস্তি খুব কঠিন।

১৬৬ নং আয়াত: নেতাদের সম্পর্কহীনতা প্রকাশ
যখন আযাব নেমে আসবে, তখন দুনিয়াতে যাদের অনুসরণ করা হতো, সেইসব নেতা ও প্রধান ব্যক্তিরা তাদের অনুসারীদের সাথে সম্পূর্ণ সম্পর্কহীনতা প্রকাশ করতে থাকবে। কিন্তু শাস্তি তাদের পেতেই হবে এবং তাদের সকল উপায়-উপকরণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।

তাফসীর: এই আয়াতে কিয়ামতের দিনের এক ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। দুনিয়াতে যারা নিজেদেরকে নেতা, পীর, বা পথপ্রদর্শক দাবি করে মানুষকে ভুল পথে চালিত করেছিল, সেদিন তারা নিজেদের দায়মুক্ত করতে চাইবে। অনুসারীদের সাথে তাদের সকল সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে। যেমন অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, অত্যাচারীরা তাদের প্রভুর সামনে দণ্ডায়মান হয়ে তাদের পরিচালকদের বলবে যে, তারা না থাকলে আমরা ঈমানদার হয়ে যেতাম। কিন্তু পরিচালকরা এর দায় নিতে অস্বীকার করবে। শয়তানও সেদিন তার অনুসারীদের বলবে যে, তোমাদের উপর আমার কোনো প্রভাব ছিল না, আমি কেবল আহ্বান করেছিলাম আর তোমরা সাড়া দিয়েছিলে। সেদিন পালাবার বা মুক্তির কোনো পথ থাকবে না।

১৬৭ নং আয়াত: অনুসারীদের আফসোস ও অনন্ত আযাব
আর যারা দুনিয়াতে তাদের অনুসারী ছিল, তারা আফসোস করে বলবে, “হায়! যদি আমাদের আর একবার সুযোগ দেওয়া হতো, তাহলে আজ এরা যেমন আমাদের সাথে সম্পর্কহীনতা প্রকাশ করছে, তেমনি আমরাও এদের সাথে সম্পর্কহীন হয়ে দেখিয়ে দিতাম।” এভাবেই আল্লাহ তাদের কৃতকর্মগুলো তাদের সামনে এমনভাবে উপস্থিত করবেন, যা কেবল দুঃখ ও আক্ষেপই বাড়াবে। জাহান্নামের আগুন থেকে বের হওয়ার কোনো পথই তারা খুঁজে পাবে না।

তাফসীর: এই আয়াতে অনুসারীদের চরম হতাশা ও আফসোস প্রকাশ করা হয়েছে। তারা সেদিন উপলব্ধি করবে যে, তারা ভুল পথে ছিল এবং তাদের নেতাদের আনুগত্য ছিল সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। কিন্তু সেই আফসোস কোনো কাজে আসবে না। তারা জান্নাতের সুঘ্রাণ থেকেও বঞ্চিত হবে এবং জাহান্নামের চিরস্থায়ী বাসিন্দা হবে। আল্লাহ অন্যত্র বলেন, কাফিরদের কর্মসমূহ মরুভূমির মরীচিকার মতো, যা পিপাসার্ত ব্যক্তি পানি মনে করলেও নিকটে গিয়ে কিছুই পায় না। অর্থাৎ, দুনিয়াতে তাদের আপাতদৃষ্টিতে ভালো কাজগুলোও পরকালে কোনো কাজে আসবে না।

বর্তমান সমাজের প্রেক্ষাপট:
তাফসীরে ফাতহুল মাজিদ অনুযায়ী, এই শিরক কেবল তৎকালীন আরব সমাজেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বর্তমানে অনেক নামধারী মুসলিমও এই ব্যাধিতে আক্রান্ত। তারা আল্লাহ ছাড়া পীর, ফকির, মাজার বা মনগড়া মা’বুদদের এমনভাবে ভালোবাসে এবং সম্মান ও আনুগত্য করে, যা কেবল আল্লাহরই প্রাপ্য। সূরা যুমারের ৩৯:৪৫ আয়াতে আল্লাহ বলেন, “এক আল্লাহর কথা বলা হলে যারা আখিরাতকে বিশ্বাস করে না তাদের অন্তর ঘৃণায় ভরে যায় এবং আল্লাহর পরিবর্তে (তাদের দেবতাগুলোর) উল্লেখ করা হলে তারা আনন্দিত হয়।”

মুমিনের বৈশিষ্ট্য ও মুক্তির পথ:
মুমিনদের অবস্থা এর সম্পূর্ণ বিপরীত। তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে সর্বাধিক ভালোবাসে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তির মাঝে তিনটি গুণ রয়েছে সে ঈমানের স্বাদ পেয়েছে, তার মধ্যে একটি হলো- কেবল আল্লাহ তায়ালা ও রাসূল তার নিকট সবচেয়ে বেশি ভালোবাসার পাত্র হওয়া।” (সহীহ বুখারী হা: ১৬)

নবী (সা.) আরও বলেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালা ব্যতীত অন্যকে তাঁর সমকক্ষ হিসেবে আহ্বান করা অবস্থায় মারা যায়, সে জাহান্নামে যাবে।” পক্ষান্তরে, যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালার সাথে কাউকে সমকক্ষ হিসেবে আহ্বান না করে মারা যায়, সে জান্নাতে যাবে। (সহীহ বুখারী হা: ৪৪৯৭, সহীহ মুসলিম হা: ৯২)

উপসংহার:
কিয়ামতের দিবসে বাতিল পথের খাজা, পীর, ফকির ও কবরপূজারীদের অপারগতা ও বিশ্বাসঘাতকতা দেখে মুশরিকরা আফসোস করবে, কিন্তু সে অনুতাপ কোনো কাজে আসবে না। তাদের সকল আমল বরবাদ হয়ে যাবে, যেমন সূরা ইবরাহীমের ১৪:১৮ আয়াতে বলা হয়েছে, “যারা তাদের প্রতিপালককে অস্বীকার করে তাদের কর্মসমূহের উপমা ভস্মসদৃশ যা ঝড়ের দিনের বাতাস প্রচণ্ড বেগে উড়িয়ে নিয়ে যায়।” সুতরাং, দুনিয়াতে ইসলামী আন্দোলনের পথে থেকে এক আল্লাহর ইবাদত ও তাঁর নির্দেশিত পথ অনুসরণ করাই মুমিনের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতের সফলতার একমাত্র চাবিকাঠি।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button