অধ্যাপক এম এ বার্ণিক: রাজপথে তখন বারুদের গন্ধ, বাতাসে রক্তের ধোঁয়া।
২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থান ছিল এক অনন্য মুহূর্ত—যেখানে তরুণদের বুকের তাজা রক্তে লেখা হয়েছিল নতুন বাংলাদেশের সূচনা।
সেই তরুণদের একজন ছিলেন নাহিদ ইসলাম—যার চোখে ছিল আগুনের শপথ, আর কণ্ঠে ছিল স্বাধীনতার গান।
তাঁর সহযোদ্ধারা পাথরের মতো অটল ছিল রাজপথে, যখন গুলির শব্দে কেঁপে উঠছিল রাজধানী।
কিন্তু ইতিহাস বড় নির্মম। যারা রক্ত দিয়ে বিজয়ের সিঁড়ি বানায়, তাদের নামই সময়ের ধুলোর নিচে চাপা পড়ে যায়;
আর যারা দূরে বসে চুপচাপ দেখেছে, তারাই পরে রাজনীতির সিংহাসনে উঠে বসে।
গণ-অভ্যুত্থানের সময় বিএনপি ছিল দূর থেকে দেখা দর্শক—
তারা তখন প্রকাশ্যে বলেছিল, “আমরা এই আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত নই।”
কিন্তু অভ্যুত্থানের পর হঠাৎই তাদের ভাগ্যে নেমে এলো অলৌকিক মুক্তি।
মামলা, সাজা, নিষেধাজ্ঞা—সব যেন জাদুর মতো উধাও হয়ে গেল।
রাজপথে যে রক্ত ঝরেছিল, সেটিই তাদের কারামুক্তির পথ খুলে দিল,
আর তার পরেই শুরু হলো তাদের রাজনৈতিক পুনর্জন্মের মহোৎসব।
যখন জুলাইযোদ্ধারা হাসপাতালে পড়ে থেকেছেন কৃত্রিম হাত-পা নিয়ে,
যখন তারা চিকিৎসার জন্য মানুষের সাহায্যের অপেক্ষায় ছিলেন,
তখন বিএনপি নেতৃত্ব বিদেশে গিয়েছে “নতুন ক্ষমতার সমীকরণ” সাজাতে।
যেখানে রাজনীতি ছিল শুধু সিঁড়ি, আর গণ-অভ্যুত্থান ছিল সেই সিঁড়ির নিচের ইট।
লন্ডনের আকাশের নিচে
তারেক রহমান ও ড. মুহম্মদ ইউনূসের বৈঠকে তৈরি হয় সেই চিত্রনাট্য,
যেখানে গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্বকে ছায়ায় ঠেলে দিয়ে,
নিজেদের ভবিষ্যৎ রাজনীতি আঁকার পরিকল্পনা নেওয়া হয়।
লক্ষ্য ছিল একটাই—“জুলাই সনদ”কে ঝুলিয়ে রেখে
জনতার রক্তের দাবিকে স্থগিত করা, সময়ের পঙ্কে তা ডুবিয়ে দেওয়া।
এরপর আসে ১৭ অক্টোবর ২০২৫—
জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় অনুষ্ঠিত হয় “জুলাই সনদ স্বাক্ষর” অনুষ্ঠান।
সেই দিনে যাদের থাকার কথা ছিল মঞ্চের মাঝখানে—
যারা দিনরাত জীবন বাজি রেখে এই সনদের ভিত্তি গড়েছিলেন—
সেই নাহিদ ইসলাম, হাসনাত আবদুল্লাহ, সারজিস আলমেরা ছিলেন বাইরে, জনতার মাঝে।
তাদের নাম উচ্চারিত হয়নি,
তাদের ত্যাগের গল্প ছাপা হয়নি কোনো পোস্টারে।
ভিতরে তখন করতালি, ক্যামেরার ঝলক, রাজনীতিক হাসির আড়ালে লুকানো ঠান্ডা হিসাব।
যারা একদিন বলেছিল “আমরা জড়িত নই”—
তারাই আজ গলায় ফুলের মালা পরে “জুলাই সনদ” স্বাক্ষর করছে,
যেন ইতিহাস তাদেরই হাতে লেখা।
এই বৈপরীত্যই আজকের বাংলাদেশের রাজনীতির মুখ,
যেখানে ত্যাগীরা হারিয়ে যায়,
আর সুযোগসন্ধানীরা রাজা হয়ে ওঠে।
যেখানে রক্তের বদলে পুরস্কার পায় ক্ষমতাবানরা,
আর সত্যকে ঢেকে ফেলা হয় কূটনীতির কাপড়ে।
রাজপথের সেই ক্লান্ত সৈনিকেরা আজও বেঁচে আছে—
তাদের চোখে আছে ক্ষোভ,
তাদের হৃদয়ে আছে সেই প্রশ্ন:
“আমরা কি শুধুই ইতিহাসের জ্বালানি?”
নাহিদ ইসলামেরা আজ নামহীন—
তাদের তাজা রক্তের গন্ধ মিশে গেছে শহরের ধুলায়,
তাদের রক্তের ওপরে দাঁড়িয়ে বিএনপি ফিরে পেয়েছে রাজনীতি ও মর্যাদা।
বাংলাদেশের ইতিহাস তাই আজ এক নতুন প্রবাদ লিখছে—
যারা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দেয়, তারা হারিয়ে যায়;
আর যারা দূর থেকে দেখে, তারা রাজা হয়ে যায়।



