বাংলাদেশরাজনীতিসম্পাদকীয়

ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের স্মৃতিচারণায় জিয়াউর রহমান: এক বিরল বন্ধুত্বের আখ্যান

অপরাধ বিচিত্রা ডেস্ক: আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের আত্মজীবনী “ফেলে আসা দিনগুলি” (তৃপ্তি প্রকাশ কুঠি, জুন ২০১১) বইতে উঠে এসেছে একাত্তরের রণাঙ্গনের বন্ধু এবং সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সঙ্গে তার গভীর সম্পর্কের নানা দিক। বইটির ১৪৯ থেকে ১৭২ পৃষ্ঠাব্যাপী এই স্মৃতিচারণা পাঠক মহলে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন তার লেখায় জিয়াউর রহমানের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত স্মৃতি এবং আদর্শিক ভিন্নতা সত্ত্বেও বিদ্যমান শ্রদ্ধাবোধের কথা তুলে ধরেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, “আপনার (জিয়াউর রহমান) সাথে আমার অনেক স্মৃতি আছে, অনেক মিল আছে।” মুক্তিযুদ্ধের সময় উভয়েরই সরল জীবনযাপনের কথা স্মরণ করে তিনি লিখেছেন, “আপনি যুদ্ধের সময় যে ঘড়িটা ব্যবহার করতেন, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী হয়েও সে ঘড়িটাই আপনার হাতে আছে। আমি আমার বাবার দেয়া বাড়িতেই আছি, বাবার কেনা আসবাবপত্রই ব্যবহার করছি। মুক্তিযুদ্ধের সময় আপনিও এক কাপড়ে ছিলেন, আমিও এক কাপড়েই ছিলাম। তখন যুদ্ধ করা, হানাদারদের আঘাত করা, দেশের স্বাধীনতা অর্জন করা ছাড়া, অন্য কোন ব্যাপার আমাদের মাথায় ছিল না।”

একাত্তরের রণাঙ্গনে জিয়াউর রহমানের স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং দুই সন্তান তারেক ও কোকোর নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত না হয়ে দেশের স্বাধীনতা অর্জনে সর্বোচ্চ মনোযোগ দেওয়ার বিষয়টিও মোশাররফ হোসেনের লেখায় বিশেষভাবে উঠে এসেছে। তিনি লিখেছেন, জিয়াউর রহমান সে সময় বার্তা বাহককে বলেছিলেন, “তাঁরা কোথায় থাকবে, কী করবে সে বিষয়ে ভাববার অবকাশ নেই। তাদেরকে তাদের মত করে সেভ থাকতে বলো।” এই ঘটনাটি জিয়ার অটল দেশপ্রেমের পরিচয় বহন করে বলে তিনি মনে করেন।

জিয়াউর রহমানের মানবিকতার একটি ঘটনার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মোশাররফ হোসেন লিখেছেন, চট্টগ্রামে বিরোধী দলের মিছিলে আক্রান্ত হয়ে তিনি যখন গুরুতর আহত হন, তখন জেনারেল জিয়াউর রহমান বিচলিত হয়ে পড়েন। তিনি তৎকালীন মিলিটারি সেক্রেটারি কর্নেল অলিকে নির্দেশ দেন সরাসরি মেডিকেল থেকে তার খবরাখবর নেওয়ার জন্য। মোশাররফ হোসেন আরও জানান, “যতক্ষণ পর্যন্ত আমার অপারেশন সফল হওয়ার খবর পাননি, ঠিক ততক্ষণ পর্যন্ত জিয়াউর রহমান আমার সংবাদের জন্য জেগে ছিলেন।”

জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ড নিয়েও ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন তার বইতে এক মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছেন। জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার আগের রাতে চট্টগ্রাম ক্লাবে তাস খেলার সময় এক কর্নেল (যিনি পরে জিয়ার হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিলেন) তাকে বলেছিলেন, “মোশাররফ ভাই, আজ তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছি, সুখবর আছে আপনাকে পরে জানাব।” মোশাররফ হোসেন তখন প্রমোশনের কথা ভেবেছিলেন, কিন্তু পরদিন জিয়ার মৃত্যুর খবর তাকে “বিশাল এক শূন্যতার সাগরে ঠেলে দেয়।” তিনি লিখেছেন, “জিয়াউর রহমান বিএনপি করেন, আর আমি আওয়ামী লীগের কর্মী সেটা বড় কথা নয়। জেনারেল জিয়াউর রহমান আমার যুদ্ধকালীন বন্ধু। আমরা জীবন বাজি রেখে একদিন যুদ্ধ করেছি। তার মৃত্যুর খবর আমাকে বিশাল এক শূন্যতার সাগরে ঠেলে দিল।”

ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের এই স্মৃতিচারণা তার ও জিয়াউর রহমানের মধ্যকার ব্যক্তিগত সম্পর্ক এবং মুক্তিযুদ্ধের সময়কার পারস্পরিক বন্ধনকে এক ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরেছে, যা রাজনৈতিক বিভাজনের ঊর্ধ্বে গিয়ে মানবিক সম্পর্কের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button