পরিবেশপ্রচ্ছদবাংলাদেশবিশ্লেষণশিক্ষাসংগৃহীত সংবাদ

একজন মানুষের আসল পরিচয় তার মুখে নয়, তার আচরণে লুকিয়ে থাকে: বুদ্ধিমান চাকরের শিক্ষণীয় গল্প

অপরাধ বিচিত্রা ডেস্ক: প্রাচীনকালে এক রাজ্যে এমন একজন রাজা ছিলেন, যার দরবারে দূরদূরান্ত থেকে লোকেরা চাকরির সন্ধানে আসত। একদিন এক রহস্যময় ব্যক্তির আগমন রাজার জীবনে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। এই গল্পটি প্রমাণ করে যে মানুষের প্রকৃত পরিচয় তার পদ বা সম্পদ দিয়ে নয়, বরং তার ব্যবহার ও আচরণের মাধ্যমেই প্রকাশিত হয়।

এক সকালে দরবারে এক অচেনা ব্যক্তি উপস্থিত হয়ে রাজার কাছে চাকরি চাইলেন। রাজা তার যোগ্যতা জানতে চাইলে লোকটি আত্মবিশ্বাসের সাথে উত্তর দিল, “আমি মানুষের মুখ দেখে বুঝতে পারি, তার ভেতরে মানুষ লুকিয়ে আছে না পশু।” এই কথা শুনে রাজা কৌতূহলী হয়ে উঠলেন এবং তাকে রাজপ্রাসাদের সবচেয়ে প্রিয় ঘোড়ার আস্তাবলের দায়িত্ব দিলেন।

কিছুদিন পর রাজা লোকটিকে ডেকে তার প্রিয় ঘোড়া সম্পর্কে জানতে চাইলেন। লোকটি বিনয়ের সাথে বলল, “মহারাজ, ঘোড়াটি দেখতে সুন্দর হলেও এটি খাঁটি জাতের নয়।” রাজার বিস্ময় দেখে তিনি অবিলম্বে অভিজ্ঞ ঘোড়সওয়ারকে ডাকলেন। ঘোড়সওয়ার নিশ্চিত করলেন যে ঘোড়াটি আসলে খাঁটি জাতের, তবে জন্মের পর মায়ের মৃত্যুর কারণে সে গরুর দুধ খেয়ে বড় হয়েছিল। চাকরটি ব্যাখ্যা করল, “খাঁটি জাতের ঘোড়া ঘাস খাওয়ার সময় মাথা উঁচু করে খায়, কিন্তু এটি গরুর মতো মাথা নিচু করে খায়।” রাজার বুদ্ধিমত্তা মুগ্ধ হয়ে চাকরটিকে শস্য, ঘি, ছাগল ও মুরগিসহ প্রচুর পুরস্কার দিলেন

রাজা এবার চাকরটিকে রাণীর প্রাসাদে নিযুক্ত করলেন। কিছুদিন পর রাজা রাণীর সম্পর্কে তার মতামত জানতে চাইলেন। লোকটি শান্তভাবে জানাল, “রাণী অত্যন্ত মার্জিত ও রাজকীয় আচরণ করলেও, তিনি জন্মসূত্রে রাণী নন।” রাজা হতভম্ব হয়ে তার শাশুড়িকে ডাকলেন। শাশুড়ি স্বীকার করলেন যে তাদের আসল কন্যাকে হারানোর পর, সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে তারা অন্য এক কন্যাকে নিজেদের মেয়ে হিসেবে লালন-পালন করেছেন। চাকরটি তখন বলল, “আসল রাজকন্যারা ভৃত্যদের সাথে শ্রদ্ধার সাথে কথা বলে, কিন্তু আপনার রাণী ভৃত্যদের আদেশ পালনের যন্ত্র মনে করেন।” আবারও মুগ্ধ হয়ে রাজা তাকে ভেড়া, ছাগল, শস্য, ঘি দিয়ে পুরস্কৃত করলেন এবং তাকে নিজের দরবারে স্থায়ী চাকরিতে নিযুক্ত করলেন।


কয়েক মাস পর রাজা মুচকি হেসে চাকরটিকে নিজের সম্পর্কে জানতে চাইলেন। চাকরটি রাজার প্রাণ না নেওয়ার প্রতিশ্রুতি নিয়ে বলল, “মহারাজ, আপনি রাজার সন্তান নন, আপনার আচরণেও রাজরক্তের ছাপ নেই।” রাগে চোখ লাল হয়ে গেলেও রাজা তার প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করলেন এবং সরাসরি তার মায়ের কাছে গেলেন। রানীমা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্বীকার করলেন যে তারা নিঃসন্তান হওয়ায় এক রাখালের শিশুকে দত্তক নিয়েছিলেন, আর সেই শিশুই হলেন রাজা।

রাজা হতবাক হয়ে আবার চাকরটিকে ডাকলেন। চাকরটি মৃদু হেসে বলল, “মহারাজ, রাজারা যখন পুরস্কার দেন, তখন তারা হীরা, মুক্তা বা সোনাদানা দেন। কিন্তু আপনি যে পুরস্কার দেন—ঘি, ছাগল, ভেড়া, শস্য—তা একজন রাখালের স্বভাব।”

এরপর চাকরটি কিছুক্ষণ নীরব থেকে এক গভীর সত্য উচ্চারণ করল, “মহারাজ, একজন মানুষের আসল পরিচয় তার মুখে নয়, তার আচরণে লুকিয়ে থাকে। পদ-মর্যাদা বা ধনসম্পদ যতই হোক না কেন, মানুষকে মানুষ করে তোলে তার ব্যবহার।

এই গল্পটি আমাদের শেখায় যে, বাহ্যিক চাকচিক্য বা সামাজিক পদমর্যাদা নয়, বরং মানুষের প্রকৃত গুণাবলি ও নৈতিক আচরণই তার আসল পরিচয় বহন করে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button