কবর জিয়ারতের সুন্নাহসম্মত পদ্ধতি ও বর্জনীয় বিদআত
ইসলামিক বিচিত্রা ডেস্ক: ইসলামে কবর জিয়ারত একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, যা মূলত মৃত্যু ও পরকালের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এর সঠিক পদ্ধতি, দোয়ার নিয়ম এবং এ ক্ষেত্রে প্রচলিত বিদআত সম্পর্কে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। এই নিবন্ধে কুরআন ও হাদিসের আলোকে কবর জিয়ারতের সুন্নাহসম্মত নিয়মাবলি এবং বর্জনীয় বিষয়াদি তুলে ধরা হলো।
১. মৃত্যু ও আখিরাত স্মরণের উদ্দেশ্যে জিয়ারত:
কবর জিয়ারতের মূল উদ্দেশ্য হলো মৃত্যু এবং পরকালীন জীবনের কথা স্মরণ করা। আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) তার মায়ের কবর জিয়ারত করতে গিয়ে কেঁদেছিলেন এবং উপস্থিত সাহাবিরাও কেঁদেছিলেন। তিনি বলেন, “আমি আমার মায়ের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়ার অনুমতি চেয়েছিলাম, কিন্তু আমাকে তা দেওয়া হয়নি। তবে আমি তার কবর জিয়ারতের অনুমতি চাইলে তিনি তা মঞ্জুর করেন। অতএব, তোমরা কবর জিয়ারত করো, কারণ এটি মৃত্যুর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।” (সহীহ মুসলিম, হা/৯৭৬)। অন্য বর্ণনায় আছে, “এটি আখিরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।”
২. কবর জিয়ারতের সুন্নত দোয়া পাঠ:
কবর জিয়ারতের সময় নির্দিষ্ট দোয়া পাঠ করা সুন্নত। বুরাইদা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) সাহাবিদের কবর জিয়ারত করতে গেলে এই দোয়াটি পড়তে বলতেন:
দোয়া: السَّلَامُ عَلَيْكُمْ أَهْلَ الدِّيَارِ مِنْ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُسْلِمِينَ وَإِنَّا إِنْ شَاءَ اللَّهُ بِكُمْ لَلَاحِقُونَ أَسْأَلُ اللَّهَ لَنَا وَلَكُمْ الْعَافِيَةَ
অর্থ: “কবর গৃহের হে মুমিন-মুসলিম অধিবাসীগণ, আপনাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। আল্লাহ চাইলে আমরাও আপনাদের সাথে মিলিত হব। আমি আমাদের জন্য এবং তোমাদের জন্য আল্লাহর নিকট নিরাপত্তা কামনা করছি।” (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৬২০)।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: আমাদের সমাজে প্রচলিত একটি দোয়া (السَّلَامُ عَلَيْكُمْ يَا أَهْلَ الْقُبُورِ يَغْفِرُ اللَّهُ لَنَا وَلَكُمْ أَنْتُمْ سَلَفُنَا وَنَحْنُ بِالْأَثَرِ) সনদগতভাবে দুর্বল, যেমনটি ইমাম আলবানী (রাহ.) ‘যঈফ তিরমিযী’তে উল্লেখ করেছেন। তাই সহীহ হাদিসে বর্ণিত দোয়াগুলো পাঠ করা উচিত।
৩. মৃতদের গুনাহ মোচনের জন্য দোয়া:
কুরআন ও হাদিসে মৃতদের জন্য ক্ষমা ও রহমত কামনার গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন: “হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে এবং আমাদের ভাইদেরকে ক্ষমা করে দাও যারা ঈমানের সাথে আমাদের আগে (দুনিয়া) থেকে চলে গেছে।” (সূরা হাশর: ৫৯)। তিনি আরও বলেন: “ক্ষমা প্রার্থনা করো নিজের জন্য এবং মুমিনদের জন্য।” (সূরা মুহাম্মাদ: ৪৭)।
সুনানে আবু দাউদে বর্ণিত আছে, রাসূল (সা.) দাফন শেষ করে কবরের পাশে দাঁড়িয়ে সাহাবিদের বলতেন, “তোমরা তোমাদের ভাইয়ের জন্য ক্ষমা চাও। দোয়া করো যেন সে স্থির থাকতে পারে। কারণ, তাকে এখনই প্রশ্ন করা হবে।” (সুনান আবু দাউদ, হাদিস নং ২৮০৪)। মোটকথা, কুরআন-হাদিসে বর্ণিত দোয়াগুলোর পাশাপাশি নিজের ভাষায়ও মৃতদের জন্য যত খুশি দোয়া করা যেতে পারে। পিতামাতার জন্য সন্তানের দোয়া বিশেষভাবে কার্যকর।
মৃতদের জন্য হাত তুলে দোয়া:
দোয়া করার সময় হাত তুলে দোয়া করা জায়েজ। উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বাকী গোরস্থান জিয়ারত করতে গিয়ে কবরবাসীদের জন্য দু’হাত তুলে দোয়া করেছিলেন। (সহীহ মুসলিম, জানাজা অধ্যায়, হা/৯৭৪)।
মৃতদের জন্য সম্মিলিতভাবে দোয়া ও বিদআতের বিধান:
তবে সম্মিলিতভাবে মোনাজাত করার ব্যাপারে কোনো সুনির্দিষ্ট দলিল নেই। অনেক আলেম কবর জিয়ারতের সময় একজন দোয়া করবে আর বাকি সবাই ‘আমিন’ ‘আমিন’ বলবে—এভাবে সম্মিলিত দোয়াকে বিদআত হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। সৌদি আরবের স্থায়ী ফতোয়া কমিটিও এর বিপক্ষে ফতোয়া দিয়েছে। তাদের মতে, দোয়া একটি ইবাদত, যা দলিলের উপর নির্ভরশীল। রাসূল (সা.) থেকে জানাজা শেষ করে সম্মিলিতভাবে দোয়া করার প্রমাণ পাওয়া যায় না। তিনি শুধু দাফন শেষে মৃত ব্যক্তির জন্য দোয়া করতে বলতেন। তাই জানাজার সালাত শেষ করে সম্মিলিতভাবে দোয়া করা জায়েজ নয় এবং এটি একটি বিদআত।
এই বিষয়গুলো অনুসরণ করে আমরা সুন্নাহসম্মত পন্থায় কবর জিয়ারত করতে পারি এবং বিদআত থেকে মুক্ত থাকতে পারি, যা আমাদের পরকালীন জীবনে কল্যাণ বয়ে আনবে।



