ইসলাম ধর্মবিশ্লেষণ

কৃপণতা: আত্মঘাতী এক নিন্দনীয় স্বভাব – কুরআন ও হাদিসের আলোকে বিশ্লেষণ

ইসলামিক বিচিত্রা ডেস্ক: ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যা মানুষকে সৎ গুণাবলি অর্জন এবং অসৎ স্বভাব পরিহারের নির্দেশ দেয়। মানুষের চারিত্রিক ত্রুটিগুলোর মধ্যে ‘কৃপণতা’ বা ‘বুখল’ অন্যতম, যা কেবল ব্যক্তির পার্থিব জীবনকেই নয়, বরং পরকালীন মুক্তির পথকেও কঠিন করে তোলে। কৃপণতা হলো আল্লাহর দেওয়া ধন-সম্পদ, জ্ঞান বা অন্য কোনো অনুগ্রহের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ব্যয় থেকে নিজেকে বিরত রাখা। এই প্রবন্ধে “কৃপণ প্রকৃতপক্ষে নিজের সাথেই কৃপণতা করে” এই মূলনীতির ওপর আলোকপাত করা হবে এবং পবিত্র কুরআন ও হাদিসের প্রামাণিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে কৃপণতার ভয়াবহ পরিণতি ও এর থেকে মুক্তির পথ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।

‘কৃপণতা’ (بخل) বলতে বোঝায় সম্পদ, সময় বা জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও তা আল্লাহর পথে, নিজের প্রয়োজনীয় খাতে কিংবা অন্যের উপকারে ব্যয় না করে জমা করে রাখা। এটি এমন এক মানসিক সীমাবদ্ধতা যা ব্যক্তিকে দানশীলতা, ত্যাগ ও সহযোগিতামূলক মনোভাব থেকে দূরে রাখে। ইসলামে কৃপণতাকে ঈমানের পরিপন্থী একটি গুরুতর পাপ হিসেবে গণ্য করা হয়, কারণ এটি মানুষকে আল্লাহর দেওয়া সম্পদ থেকে কাউকে সাহায্য করা থেকে বিরত রাখে। হাদিসে স্পষ্ট বলা হয়েছে, “কৃপণতা এবং ঈমান কোনো মুসলমানের অন্তরে একত্রে অবস্থান করতে পারে না।”

কৃপণতা মানুষের অন্তরকে সংকীর্ণ করে, তাকে নিচু মানসিকতার দিকে ঠেলে দেয় এবং সামাজিক সম্পর্ক নষ্ট করে। এটি আল্লাহর দেওয়া অনুগ্রহের প্রতি অকৃতজ্ঞতা প্রকাশের শামিল। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা এরশাদ করেন:
“যেসব লোকেরা কৃপণ ও অন্যকে কৃপণতার নির্দেশ দেয় এবং যা তাদেরকে আল্লাহ দান করেছেন তা প্রচ্ছন্নভাবে গোপন করে রাখে।” (সূরা নিসা ৪: ৩৭)

রাসূলুল্লাহ (সা.) কৃপণতার তীব্র নিন্দা করেছেন। তিনি বলেন:
“যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকার পরও (সাওয়ালের কারণে) আসা কোনো দরিদ্রকে বিমুখ করে, তার জন্য আল্লাহর কাছে কঠিন দিন হবে।”
অন্য এক হাদিসে রাসূল (সা.) বলেন, “বুখলি মানুষ হলো সেই, যার সম্পর্কে আমার কথা বললে, সে জানে কিন্তু সালাত (আমাতে সালাম বা প্রীতিবচন) পাঠায় না।”
তিনি আরও বলেছেন, “দানের কারণে কোনো কিছু কমে না; আল্লাহ মানুষকে কিছু দিয়ে বাড়িয়ে দেন।”

কৃপণতার প্রভাব ব্যক্তিগত ও সামাজিক উভয় স্তরেই ব্যাপক।

ব্যক্তিগত দিক:

  • আত্মিক দারিদ্র্য: মন ও হৃদয় শুষ্ক হয়ে ওঠে।
  • গুণহীনতা: মানুষের মধ্যে সন্দেহ ও অবিশ্বাস জন্মায়।
  • সম্পর্ক অবনতি: সামাজিক বন্ধন দুর্বল হয়।

সামাজিক দিক:

  • দরিদ্রদের প্রতি অবহেলা: সমাজে অভাবী ও দুর্বলদের প্রতি অবহেলা বাড়ে।
  • সহযোগিতার অভাব: দানশীলতা ও সহযোগিতার মনোভাব দুর্বল হয়।
  • বৈষম্য বৃদ্ধি: সামাজিক অস্থিরতা ও বৈষম্য বৃদ্ধির সম্ভাবনা তৈরি হয়।


কৃপণতা নিজের সাথেই কৃপণতা—এই প্রশ্নের উত্তর ইসলামের মৌলিক শিক্ষায় নিহিত। ইসলামে সম্পদকে আল্লাহর পক্ষ থেকে আমানত এবং পরীক্ষার বস্তু মনে করা হয়। একজন কৃপণ ব্যক্তি যখন তার আমানতকে আল্লাহর নির্দেশিত পথে (যেমন: যাকাত, সাদাকা, আত্মীয়-স্বজনের হক, নিজের ও পরিবারের প্রয়োজনীয় ব্যয়) খরচ করতে কার্পণ্য করে, তখন সে প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর দেওয়া অনুগ্রহের প্রতি অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। এর মাধ্যমে সে নিজেরই ক্ষতি ডেকে আনে, যা কুরআনের আয়াতে স্পষ্ট

“তিনি যদি কখনো তোমাদের সম্পদ চান এবং সবটাই চান তাহলে তোমরা কৃপণতা করবে এবং তিনি তোমাদের ঈর্ষাপরায়ণতা প্রকাশ করে দিবেন।” (সূরা মুহাম্মদ: ৩৭)

অর্থাৎ, আল্লাহ মানুষকে এমন বড় পরীক্ষায় ফেলেন না যা থেকে তাদের দুর্বলতাই শুধু প্রকাশ পেতো। পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ তা’আলা আরও বলেন:
“দেখো, তোমাদেরকে আল্লাহর পথে অর্থ-সম্পদ ব্যয় করতে আহ্বান জানানো হচ্ছে অথচ তোমাদের মধ্যকার কিছু লোক কৃপণতা করেছে। যারা কৃপণতা করে তারা প্রকৃতপক্ষে নিজের সাথেই কৃপণতা করছে। আল্লাহ তো অভাব শূন্য। তোমরাই তার মুখাপেক্ষী। তোমরা যদি মুখ ফিরিয়ে নাও তাহলে আল্লাহ তোমাদের স্থানে অন্য কোনো জাতিকে নিয়ে আসবেন। তারা তোমাদের মতো হবে না।” (সূরা মুহাম্মাদ: ৩৮)

এই আয়াতগুলো স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, ব্যয় না করার মাধ্যমে কৃপণ ব্যক্তি আল্লাহর প্রাচুর্যের কোনো ক্ষতি করতে পারে না, বরং সে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও উত্তম প্রতিদান থেকে নিজেকে বঞ্চিত করে।

কৃপণতা কেবল পরকালের নয়, বরং দুনিয়ার জীবনেও ব্যক্তির জন্য অকল্যাণ বয়ে আনে। কৃপণ ব্যক্তি সর্বদা দরিদ্র হয়ে যাওয়ার ভয়ে ভীত থাকে, যা শয়তানের প্ররোচনা। কুরআনুল কারীমে আল্লাহ বলেন:
“শয়তান তোমাদেরকে দরিদ্রতার ভয় দেখায় এবং তোমাদেরকে কার্পণ্যের আদেশ করে। অথচ আল্লাহ তোমাদেরকে তাঁর পক্ষ থেকে ক্ষমা ও দয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।” (সূরা আল-বাকারা: ২৬৮)

কুরআন ও হাদিসে কৃপণতার যে সবচেয়ে ভয়াবহ পরিণতির কথা বলা হয়েছে, তা হলো কিয়ামত দিবসে এর কঠিন শাস্তি। আল্লাহ তা’আলা কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে কৃপণদের সম্পর্কে বলেছেন:
“আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে যা তাদেরকে দিয়েছেন, তা নিয়ে যারা কৃপণতা করে, তারা যেন মনে না করে যে তা তাদের জন্য কল্যাণকর, বরং তা তাদের জন্য অকল্যাণকর। তারা যাতে কৃপণতা করেছে, কিয়ামতের দিন তারই বেড়ি তাদের গলায় পরিয়ে দেওয়া হবে।” (সূরা আলে ইমরান: ১৮০)

অপর আয়াতে তিনি বলেন:
“যারা কৃপণতা করে এবং মানুষকে কৃপণতার নির্দেশ দেয়; আর গোপন করে তা, যা আল্লাহ তাদেরকে স্বীয় অনুগ্রহে দান করেছেন। আর আমি প্রস্তুত করে রেখেছি কাফিরদের জন্য লাঞ্ছনাকর আযাব।” (সূরা আন-নিসা: ৩৬-৩৭)

এই আয়াতগুলো প্রমাণ করে যে, কৃপণতা ব্যক্তি নিজের আমানতকে রক্ষা না করে, মূলত নিজের ওপরই আযাব ডেকে আনে।

রাসূলুল্লাহ (সা.) কৃপণতাকে উম্মতের জন্য অত্যন্ত মারাত্মক ব্যাধি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন:
“তোমরা কৃপণতা থেকে বেঁচে থাকো। কেননা তোমাদের পূর্ববর্তীদেরকে এই কৃপণতাই ধ্বংস করেছে। অর্থলোভ তাদের কৃপণতার নির্দেশ দিয়েছে, ফলে তারা কৃপণতা করেছে, তাদের আত্মীয়তা ছিন্ন করার নির্দেশ দিয়েছে, তখন তারা তা-ই করেছে এবং তাদের পাপাচারে প্ররোচিত করেছে, তখন তারা তাতে লিপ্ত হয়েছে।” (সহীহ আবু দাউদ)।

দানশীলতা ও কৃপণতার ফল তাৎক্ষণিক ও সুদূরপ্রসারী—তা নিম্নলিখিত হাদিসে স্পষ্ট:
“প্রতিদিন সকালে দুজন ফেরেশতা অবতরণ করেন। তাঁদের একজন বলেন, ‘হে আল্লাহ! দাতাকে তার দানের বিনিময় দিন।’ আর অপরজন বলেন, ‘হে আল্লাহ! কৃপণকে ধ্বংস দিন’।” (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)।

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, “দান-খয়রাত ওই সব লোকের জন্য, যারা আল্লাহর কাছে আবদ্ধ হয়ে গেছে, জীবিকার সন্ধানে অন্যত্র ঘোরাফেরা করতে সক্ষম নয়… তোমরা বৈধ সম্পদ থেকে যা ব্যয় করো সে বিষয়ে আল্লাহ সম্যকরূপে অবগত।” (সুরা বাকারা, আয়াত: ২৭৩)।

এই আয়াতে মূলত মুহাজিরদের কথা বলা হয়েছে। বিজ্ঞ আলেমদের মতে, বর্তমান যুগে যারা দ্বিন শিক্ষা ও প্রচারে ব্যস্ত থাকার কারণে উপার্জনের উৎস নেই বা নগণ্য, তাদের সহায়তাকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। এছাড়াও অনেক মধ্যবিত্ত মানুষ আছেন যারা অভাবে জর্জরিত কিন্তু মুখ খুলে কাউকে বলেন না। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) এমন লোকদেরকেই ‘প্রকৃত মিসকিন’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

সঠিক পদ্ধতিতে আল্লাহর রাস্তায় দান-সদকা করার ফজিলত অপরিসীম। মহান আল্লাহ তাদের দানের প্রতিদান বহু গুণে বাড়িয়ে দেবেন এবং ইহকালীন ও পরকালীন নিরাপত্তা দান করবেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, “যারা নিজেদের সম্পদ রাতে ও দিনে, প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে ব্যয় করে থাকে, তাদের জন্য সেই দানের সওয়াব তাদের প্রতিপালকের কাছে রয়েছে এবং তাদের কোনো ভয় নেই, তারা চিন্তিতও হবে না।” (সুরা বাকারা, আয়াত: ২৭৪)।

কৃপণতা কাটিয়ে ওঠার জন্য নফল ও ওয়াজিব দান (যেমন যাকাত, সাদাকা) নিয়মিত করা, মনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া যে সম্পদ আল্লাহর আমানত এবং দান করলে বরকত ফিরে আসে—এগুলো অপরিহার্য। রাসূলুল্লাহ (সা.) কৃপণতা থেকে বাঁচার জন্য একটি দোয়া শিখিয়েছেন:

দোয়া: اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْهَمِّ وَالْحَزَنِ، وَالْعَجْزِ وَالْكَسَلِ، وَالْجُبْنِ وَالْبُخْلِ، وَضَلَعِ الدَّيْنِ وَغَلَبَةِ الرِّجَالِ
অর্থ: “হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে দুশ্চিন্তা ও দুঃখ থেকে, অক্ষমতা ও অলসতা থেকে, ভীরুতা ও কৃপণতা থেকে এবং ঋণের বোঝা ও মানুষের প্রাধান্য (বা নিপীড়ন) থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।” (সহীহ বুখারী: ৬৩৬৯)।

পরিশেষে বলা যায়, “কৃপণ প্রকৃতপক্ষে নিজের সাথেই কৃপণতা করে”—এই উক্তিটি একটি গভীর সত্য। কৃপণতা কেবল অর্থের সীমাবদ্ধতা নয়, এটি মানুষের মন, চরিত্র, সামাজিক বন্ধন এবং ঈমানের দিককেও ক্ষুণ্ন করে। আল্লাহর দেওয়া সামর্থ্য ও সম্পদকে সঠিক পথে ব্যয় না করার মাধ্যমে কৃপণ ব্যক্তি মনে করে যে, সে সম্পদকে সুরক্ষিত রাখছে, কিন্তু বাস্তবতা হলো, সে আল্লাহর ক্ষমা, দয়া, জান্নাতের সওয়াব এবং সমাজের মানুষের ভালোবাসা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করে। সে নিজের পরকালের জন্য সেই সম্পদকে এক ভয়াবহ শাস্তির উপকরণে পরিণত করে।

ইসলামের শিক্ষা হলো— মধ্যপন্থা অবলম্বন করা, যেখানে কৃপণতা এবং অপচয় উভয়ই পরিহার করা হয়। মুমিনের কর্তব্য হলো শয়তানের দারিদ্র্যের ভয়কে উপেক্ষা করে আল্লাহর প্রতিশ্রুত ক্ষমা ও অনুগ্রহের আশায়, নিজের ফরজ-ওয়াজিব দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি মুক্তহস্তে দান-সাদকা করা। এই আত্ম-শুদ্ধির মাধ্যমেই একজন মানুষ কৃপণতার অভিশাপ থেকে মুক্তি পেয়ে ইহকালে সম্মান ও পরকালে চিরস্থায়ী সফলতা লাভ করতে পারে। অতএব, কৃপণতা পরিহার করে দানশীলতা ও বদান্যতার পথে চলাই একজন মুমিনের প্রকৃত সফলতা ও আত্মকল্যাণ। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে আল্লাহর নির্দেশিত পদ্ধতিতে দান-সদকা করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button