ইসলাম ধর্ম

ইস্তেগফারের অলৌকিক শক্তি: সমস্যা সমাধানের এক অব্যর্থ আমল

ইসলামিক বিচিত্রা ডেস্ক: জীবনে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা ও প্রতিকূলতা আমাদের প্রতিনিয়ত ঘিরে রাখে – তা সে চাকরির অভাব, ব্যবসার মূলধনের সংকট, রিজিকের পেরেশানি, বিপদ-আপদ, দুঃখ-দুশ্চিন্তা, বিয়ের পথে বাধা, সন্তান লাভে আকুলতা, পার্থিব সমৃদ্ধির অভাব কিংবা ফসলের ভালো ফলনের আকাঙ্ক্ষাই হোক না কেন। ইসলামে এমন এক আমলের কথা বলা হয়েছে, যা এসব সমস্যার সমাধানের এক শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে কাজ করে – আর তা হলো ‘ইস্তেগফার’ বা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা। ইস্তেগফারকে নিজের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ করে নিলে আল্লাহ তায়ালা মানুষের জন্য অপ্রত্যাশিত সব দুয়ার খুলে দেন।

হাদিসের নির্দেশনা ও ইস্তেগফারের ফজিলত:
হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, “যে ব্যক্তি ইস্তেগফারকে নিজের জন্য আবশ্যক বানিয়ে নিবে, আল্লাহ তায়ালা তার জন্য প্রতিটি সংকীর্ণ অবস্থা থেকে বের হওয়ার পথ খুলে দিবেন, তার প্রতিটি উদ্বেগ-অস্থিরতা দূর করে দিবেন এবং তাকে কল্পনাতীত উৎস থেকে রিজিক প্রদান করবেন।” এই হাদিস ইস্তেগফারের অপার ক্ষমতাকে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরে। চলার পথে, বসার মুহূর্তে, বা যেকোনো অবস্থায় ঠোঁটে ইস্তেগফারের আমল জারি রাখলে তা জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে আসে।

হাসান বসরী (রাহ.) এর বিখ্যাত ঘটনা:
বিখ্যাত তাবেয়ী হাসান বসরী (রাহ.)-এর একটি ঘটনা ইস্তেগফারের কার্যকারিতা সম্পর্কে এক জীবন্ত প্রমাণ। একবার তাঁর কাছে একজন ব্যক্তি এসে খরা আক্রান্ত ফসলের জন্য আমল চাইলেন। তিনি তাকে ‘ইস্তেগফার’ করার পরামর্শ দিলেন। কিছুক্ষণ পর আরেকজন এসে রিজিকের সংকটের কথা জানালে তাঁকেও একই পরামর্শ দিলেন। এমনিভাবে এক ব্যক্তি সন্তান লাভের আমল চাইলে, হাসান বসরী (রাহ.) তাঁকেও ইস্তেগফার করতে বললেন। উপস্থিত ছাত্ররা যখন এর কারণ জানতে চাইলেন, তখন তিনি বললেন, “আমি নিজের পক্ষ থেকে কিছুই বলিনি। এটা বরং আল্লাহ তায়ালা তার কুরআনে শিখিয়েছেন।” এরপর তিনি সূরা নূহ এর ১০-১২ আয়াতগুলো তেলাওয়াত করলেন, যেখানে নূহ (আ.) তাঁর কওমকে বলেছিলেন:

“তোমরা তোমাদের রবের কাছে ইস্তেগফার করো (ক্ষমা চাও)। নিশ্চয় তিনি অতি ক্ষমাশীল। তিনি তোমাদের উপর অজস্র বারিধারা বর্ষণ করবেন। তিনি তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি বৃদ্ধির মাধ্যমে তোমাদের সাহায্য করবেন। তোমাদের জন্যে উদ্যান তৈরি করবেন, তোমাদের জন্যে নদীনালা প্রবাহিত করবেন।” (সূরা নূহ: ১০-১২)

এই আয়াতগুলো স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দেয় যে, ইস্তেগফার কেবল পাপ মোচনের পথ নয়, বরং দুনিয়ার যাবতীয় সংকট থেকে মুক্তি এবং সমৃদ্ধি লাভের এক কার্যকর উপায়।

ইস্তেগফারের গুরুত্বপূর্ণ দোয়া সমূহ:
ইস্তেগফার অর্থ হলো আল্লাহর কাছে নিজের গুনাহের জন্য লজ্জিত ও অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চাওয়া। হাদিসে ইস্তেগফারের বেশ কিছু দোয়া এসেছে:

১. সর্বজনীন ইস্তেগফার (আস্তাগফিরুল্লাহ):
আরবি: أَسْتَغْفِرُ اللَّهَ
উচ্চারণ: আস্তাগফিরুল্লাহ্।
অর্থ: আমি আল্লাহর ক্ষমা প্রার্থনা করছি।
রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রতি ওয়াক্তের ফরয সালাতে সালাম ফিরানোর পর এই দোয়া তিনবার পড়তেন। (মিশকাত-৯৬১)

২. ক্ষমা ও তাওবার সম্মিলিত দোয়া:
আরবি: أَسْتَغْفِرُ اللَّهَ وَأَتُوبُ إِلَيْهِ
উচ্চারণ: আস্তাগফিরুল্লাহ্ ওয়া আতুবু ইলাইহি।
অর্থ: আমি আল্লাহর ক্ষমা প্রার্থনা করছি ও তাঁর দিকে ফিরে আসছি।
রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রতিদিন ৭০ বারের অধিক তাওবা ও ইস্তেগফার করতেন। (বুখারী-৬৩০৭)

৩. প্রভু কর্তৃক ক্ষমা ও তাওবা কবুলের দোয়া:
আরবি: رَبِّ اغْفِرْ لِي وَتُبْ عَلَيَّ إِنَّكَ (أَنْتَ) التَّوَّابُ الرَّحِيمُ (الْغَفُورُ)
উচ্চারণ: রব্বি ইগফিরলি ওয়াতুব আলাইয়্যা ইন্নাকা (আনতা) আত্তাওয়াবুর রাহিম (আল গাফূর)।
অর্থ: হে আমার প্রভু, আপনি আমাকে ক্ষমা করুন এবং আমার তাওবা কবুল করুন। নিশ্চয় আপনি মহান তাওবা কবুলকারী, করুণাময় (দ্বিতীয় বর্ণনায়: তাওবা কবুলকারী ও ক্ষমাকারী)।
রাসূলুল্লাহ (সা.) মসজিদে বসে এক বৈঠকেই এই দোয়া ১০০ বার পড়েছেন। (আবূ দাঊদ-১৫১৬, ইবনু মাজাহ-৩৮১৪, তিরমিযী-৩৪৩৪, মিশকাত-২৩৫২)

৪. আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি সহ ক্ষমা প্রার্থনা:
আরবি: أَسْتَغْفِرُ اللَّهَ الَّذِي لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ وَأَتُوبُ إِلَيْهِ
উচ্চারণ: আস্তাগফিরুল্লাহাল্লাজি লা ইলাহা ইল্লা হুয়াল হাইয়্যুল কাইয়্যুমু ওয়া আতুবু ইলাইহি।
অর্থ: আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই, তিনি ছাড়া প্রকৃতপক্ষে কোনো মা‘বূদ নেই, তিনি চিরঞ্জীব, চিরস্থায়ী এবং তাঁর কাছে তাওবাহ করি।
এই দোয়া পড়লে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিবেন – যদিও সে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়নকারী হয়। (আবু দাউদ-১৫১৭, তিরমিযী-৩৫৭৭, মিশকাত-২৩৫৩)

৫. ক্ষমা চাওয়ার শ্রেষ্ঠ দোয়া: সাইয়্যিদুল ইস্তিগফার:
আরবি: اللَّهُمَّ أَنْتَ رَبِّي لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ خَلَقْتَنِي وَأَنَا عَبْدُكَ وَأَنَا عَلَى عَهْدِكَ وَوَعْدِكَ مَا اسْتَطَعْتُ أَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ مَا صَنَعْتُ أَبُوءُ لَكَ بِنِعْمَتِكَ عَلَيَّ وَأَبُوءُ لَكَ بِذَنْبِي فَاغْفِرْ لِي فَإِنَّهُ لَا يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلَّا أَنْتَ
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা আনতা রাব্বি লা ইলাহা ইল্লা আনতা খালাক্বতানি ওয়া আনা আবদুকা ওয়া আনা আলা আহদিকা ওয়া ওয়াদিকা মাসতাত্বা’তু। আউজুবিকা মিন শাররি মা সানা’তু। আবুউ লাকা বিনি’মাতিকা আলাইয়্যা ওয়া আবুউ লাকা বিজাম্বি ফাগফিরলি ফা-ইন্নাহু লা ইয়াগফিরুজ জুনুবা ইল্লা আনতা।
অর্থ: হে আল্লাহ! তুমিই আমার প্রতিপালক। তুমি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। তুমিই আমাকে সৃষ্টি করেছ। আমি তোমারই গোলাম। আমি যথাসাধ্য তোমার সঙ্গে প্রতিজ্ঞা ও অঙ্গীকারের উপর আছি। আমি আমার সব কৃতকর্মের কুফল থেকে তোমার কাছে পানাহ চাচ্ছি। তুমি আমার প্রতি তোমার যে নিয়ামত দিয়েছ তা স্বীকার করছি। আর আমার কৃত গুনাহের কথাও স্বীকার করছি। তুমি আমাকে মাফ করে দাও। কারণ তুমি ছাড়া কেউ গুনাহ ক্ষমা করতে পারবে না।
যে ব্যক্তি সকাল-সন্ধ্যায় সাইয়্যিদুল ইস্তিগফার অর্থ বুঝে দৃঢ় বিশ্বাস সহকারে পড়বে, সে ঐ দিন কিংবা রাতে মারা গেলে অবশ্যই জান্নাতে যাবে। (বুখারী: ৬৩০৬)

উপসংহার:
ইস্তেগফার কেবল একটি দৈনন্দিন আমল নয়, বরং এটি দুনিয়া ও আখিরাতের সকল কল্যাণের চাবিকাঠি। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আমাদের সকলকে ইস্তেগফারের গুরুত্ব অনুধাবন করে তা নিয়মিত আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button