ইসলাম ধর্ম

তাওহিদের মূল ঘোষণা: সুরা ইখলাস ও জান্নাতের প্রতিশ্রুতি

কোরআনের এক-তৃতীয়াংশের সমমর্যাদাসম্পন্ন এই সুরা আল্লাহর একত্বের পরিপূর্ণ পরিচয় তুলে ধরে।

ইসলামিক বিচিত্রা ডেস্ক: পবিত্র কোরআনের অন্যতম বহুল পঠিত ও মহিমান্বিত সুরা হলো সুরা ইখলাস (সুরা নং ১১২)। এই অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ সুরাটি মুসলিম জীবনে আল্লাহর একত্ববাদ বা তাওহিদের সর্বোচ্চ ঘোষণা হিসেবে গণ্য। মাত্র চারটি আয়াতে সুরাটি ইসলামের মূল বিশ্বাসের সারমর্মকে ধারণ করেছে—আল্লাহ এক, তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন, তাঁর কোনো জন্মদাতা বা সন্তান নেই এবং তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই।

রাসুলুল্লাহ (সা.) সুরা ইখলাসের অসাধারণ মর্যাদা সম্পর্কে বলেছেন: ‘সুরা ইখলাস কোরআনের এক-তৃতীয়াংশের সমান।’ (সহিহ বুখারি: ৬৬৪৩)। এর প্রধান বিশেষত্বগুলো হলো:

  • এটি পবিত্র কোরআনের এক-তৃতীয়াংশের সমমর্যাদা বহন করে।
  • আল্লাহর একত্ববাদের (তাওহিদ) সবচেয়ে পরিপূর্ণ ব্যাখ্যা এতে নিহিত।
  • এটি মুসলমানদের প্রতিদিনের আমলে নিয়মিত পাঠ্য।

এছাড়া, এই সুরাটি দশবার পাঠ করলে জান্নাতে একটি প্রাসাদ লাভের সুসংবাদ রয়েছে।

সুরা ইখলাসের চারটি আয়াত আল্লাহর একক সত্তার পরিচয় তুলে ধরে, যা শিরকের সমস্ত ধারণাকে বাতিল করে দেয়।

১. আল্লাহর একক সত্তা:
قُلْ هُوَ اللّٰهُ أَحَدٌ
অর্থ: ‘বলুন, তিনিই আল্লাহ, এক ও অদ্বিতীয়।’ (সুরা ইখলাস: ১)

এই আয়াতটি আল্লাহর একক সত্তা ও সার্বভৌমত্বের ঘোষণা দেয়। এটি বোঝায় যে ইবাদত, ভক্তি ও ভয় কেবল এক আল্লাহর জন্য নির্ধারিত। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে: ‘তোমাদের ইলাহ এক ইলাহ। তিনি ছাড়া কোনো (সত্য) ইলাহ নেই।’ (বাকারা: ১৬৩)

২. আল্লাহর চরম মুখাপেক্ষীহীনতা:
اللّٰهُ الصَّمَدُ
অর্থ: ‘আল্লাহ কারো মুখাপেক্ষী নন, বরং সকলেই তাঁর মুখাপেক্ষী।’ (সুরা ইখলাস: ২)

‘আস-সামাদ’ বলতে এমন সত্তাকে বোঝানো হয় যিনি অভাবমুক্ত, পূর্ণাঙ্গ এবং পরম মুখাপেক্ষীহীন। সমগ্র সৃষ্টি তাঁর সাহায্যপ্রার্থী হলেও তিনি কারো ওপর নির্ভরশীল নন। এই বিষয়ে কোরআনের বার্তা: ‘হে মানবজাতি! তোমরাই আল্লাহর মুখাপেক্ষী, আর আল্লাহ অভাবমুক্ত।’ (ফাতির: ১৫)

৩. জন্ম ও বংশধর থেকে পবিত্রতা:
لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ
অর্থ: ‘তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং তাঁকেও জন্ম দেওয়া হয়নি।’ (সুরা ইখলাস: ৩)

এটি আল্লাহর সত্তার চিরন্তনতা ও পবিত্রতা নিশ্চিত করে। জন্ম নেওয়া বা কাউকে জন্ম দেওয়া সৃষ্টির বৈশিষ্ট্য, স্রষ্টার নয়। কোরআনে আরও এসেছে: ‘তিনি কিভাবে সন্তানের অধিকারী হবেন, যেখানে তাঁর কোনো সঙ্গীই নেই?’ (আনআম: ১০১)

৪. অতুলনীয় ও তুলনাহীন স্রষ্টা:
وَلَمْ يَكُن لَّهُۥ كُفُوًا أَحَدٌ
অর্থ: ‘আর তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই।’ (সুরা ইখলাস: ৪)

আল্লাহর গুণাবলী, নাম, ক্ষমতা বা সত্তায় কোনো কিছুর সাথে তাঁর তুলনা চলে না। তিনি অতুলনীয়, এক ও অদ্বিতীয়। আল্লাহ তাআলা বলেছেন: ‘কোনো কিছুই তাঁর অনুরূপ নয়, আর তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।’ (শূরা: ১১)

  • কোরআনের এক-তৃতীয়াংশ: এই সুরা পাঠের মাধ্যমে কোরআনের এক-তৃতীয়াংশ পাঠের সওয়াব লাভ হয়।
  • আল্লাহর ভালোবাসা: এক সাহাবি সুরাটিকে ভালোবাসার কারণ হিসেবে আল্লাহর পরিচয় পাওয়ার কথা বলায় রাসুল (সা.) বলেন, ‘তাহলে আল্লাহও তোমাকে ভালোবাসেন।’ (সহিহ বুখারি: ৭৩৭৫, মুসলিম হাদিস: ৮১৩)
  • জান্নাতে প্রাসাদ: যে ব্যক্তি সুরা ইখলাস দশবার পাঠ করবে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতে একটি প্রাসাদ নির্মাণ করবেন। (মুসনাদে আহমদ: ১৫৬১০)
  • দৈনন্দিন আমল: রাসুলুল্লাহ (সা.) নিয়মিত নফল নামাজে ও ঘুমানোর আগে সুরা ইখলাস পাঠ করতেন।

সুরা ইখলাস হলো একজন মুসলমানের ঈমানের কেন্দ্রবিন্দু। এর প্রতিটি শব্দ শিরকের বিরুদ্ধে এক মজবুত দুর্গ। এর মাধ্যমে একজন মুমিন শিরক থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে এবং আল্লাহর মহত্ত্ব উপলব্ধির মাধ্যমে আত্মিক পরিশুদ্ধি অর্জন করতে পারে। নামাজে, ঘুমানোর আগে ও অন্যান্য জিকিরের সময় এই সুরা নিয়মিত পাঠ করা উচিত।

যে ব্যক্তি খাঁটি মনে এই সুরা পাঠ করে এবং এর অর্থ অনুধাবন করে, তার হৃদয় তাওহিদের আলোয় আলোকিত হয়। সুরা ইখলাসের প্রতি ভালোবাসা ও নিয়মিত আমল মুমিনকে জান্নাতের দিকে নিয়ে যায়। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে তাওহিদের শিক্ষায় জীবন আলোকিত করার এবং সুরা ইখলাসের বার্তা হৃদয়ে ধারণ করার সুযোগ দিন। আমিন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button