ইসলাম ধর্ম

ইসলামের শেষ দিক নির্দেশনা ‘বিদায় হজের ভাষণ’

আরাফাতের ময়দানে রাসূল (সা:)-এর ঐতিহাসিক ভাষণে তাকওয়া, সাম্য, নারী ও শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত করা হয়

অপরাধ বিচিত্রা ডেস্ক: ১০ম হিজরি বা ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে হজের সময় আরাফাতের ময়দানে ইসলাম ধর্মের শেষ রাসুল হযরত মুহাম্মাদ (সা:) লক্ষাধিক সাহাবীর সমাবেশে এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন, যা ইতিহাসে ‘বিদায় হজের ভাষণ’ বা ‘বিদায় খুৎবা’ নামে পরিচিত। জাবাল-এ-রাহমাত টিলার শীর্ষে দাঁড়িয়ে প্রদত্ত এটিই ছিল তাঁর জীবদ্দশার শেষ ভাষণ। ইসলামের চূড়ান্ত মূল্যবোধ ও মুসলিম জাতির করণীয় সম্পর্কে এই ভাষণে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়।

ইসলাম ধর্ম ধাপে ধাপে পূর্ণতা লাভ করেছিল, যার চূড়ান্ত ঘোষণা ছিল এই ভাষণ। ভাষণ প্রদানের সময় কোরআনের সূরা মায়িদাহ’র ৩ নম্বর আয়াতটি অবতীর্ণ হয়: “আজ আমি তোমাদের ধর্মকে পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহকারীকে সুসম্পন্ন করলাম, আর ইসলামকে তোমাদের ধর্ম হিসেবে মনোনীত করলাম।”

এই ঐতিহাসিক ভাষণটি কেবল উপাসনার অনুশাসন ছিল না, বরং এতে মানবসমাজের জন্য করণীয় সম্পর্কে স্পষ্ট ভাষায় দিকনির্দেশনা ছিল। ঈশ্বরের (আল্লাহর) প্রতি আনুগত্য ও তাঁর সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি, মানবজাতির ঐক্য, আধ্যাত্মিক ভ্রাতৃত্ব, সামাজিক স্বাধীনতা, গণতান্ত্রিক সাম্য, তাকওয়া বা দায়িত্বনিষ্ঠতা, এবং পাপাচারের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি ছিল এই ভাষণের মূল বিষয়বস্তু।

ভাষণটি পূর্ণাঙ্গরূপে সংরক্ষিত না হলেও বিভিন্ন হাদিস (সহিহ বুখারী, সহিহ মুসলিম, তিরমিজি শরীফ), তাফসির, ইতিহাস ও জীবনীগ্রন্থে আংশিক ও খণ্ড খণ্ড আকারে পাওয়া যায়। ইমাম আহমদ বিন হাম্বল তার মসনুদ-এর ১৯৭৭৮ সংখ্যক হাদিসে এর দীর্ঘতম উদ্ধৃতি দিয়েছেন।

হযরত মুহাম্মদ (সা:) দুপুরের পর হামদ ও সানার মাধ্যমে তাঁর ভাষণ শুরু করেন এবং বলেন, “হে মানুষ! তোমরা আমার কথা শোনো। এরপর এই স্থানে তোমাদের সাথে আর একত্রিত হতে পারবো কিনা জানিনা!”

১. মানবজাতির ঐক্য ও সাম্য:
রাসূল (সা:) কোরআনের আয়াত উদ্ধৃত করে বলেন: “হে মানবজাতি তোমাদেরকে আমি এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি, এবং তোমাদেরকে সমাজ ও গোত্রে ভাগ করে দিয়েছি। যেন তোমরা পরস্পরের পরিচয় জানতে পারো।” তিনি স্পষ্ট করে দেন, মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ নেই। আরবের উপর কোনো অনারবের বা সাদার উপর কালোর কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বেশী সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী, যে আল্লাহকে ভালোবাসে।

২. সম্মান, সম্পদ ও জীবনের পবিত্রতা:
তিনি বলেন, “তোমাদের রক্ত, তোমাদের সম্মান, তোমাদের সম্পদ পরস্পরের জন্য চিরস্থায়ীভাবে হারাম অর্থাৎ পবিত্র ও নিরাপদ করা হলো যেমন আজকের এই মাস এই শহর সকলের জন্য পবিত্র ও নিরাপদ।”

৩. নৈতিকতা ও ঈর্ষা পরিহার:
মুহাম্মদ (সা:) বলেন, “তোমরা ঈর্ষা ও হিংসা-বিদ্বেষ থেকে দূরে থাকবে। ঈর্ষা ও হিংসা মানুষের সকল সৎগুণকে ধ্বংস করে।”

৪. নারীর অধিকার ও নিরাপত্তা:
তিনি নারীদের সম্পর্কে সতর্ক করে বলেন, “তাদের সাথে নিষ্ঠুর আচরণ করো না। তাদের উপর যেমন তোমাদের অধিকার রয়েছে, তেমনি তোমাদের উপর তাদেরও অধিকার রয়েছে। সুতরাং তাদের কল্যাণের দিকে সবসময় খেয়াল রেখো।” নারীর পূর্ণ নিরাপত্তা, সম্মান ও অধিকার নিশ্চিত করার জন্য মুসলমানদের দায়িত্ব দেন।

৫. শ্রমিক ও অধীনস্থের অধিকার:
রাসূল (সা:) অধীনস্থদের প্রতি সতর্ক করে বলেন, “তোমরা নিজেরা যা খাবে তাদেরও তা খাওয়াবে। নিজেরা যা পরবে তাদেরও তা পরাবে। শ্রমিকের শরীরের ঘাম শুকানোর আগেই তার মজুরি পরিশোধ করবে।”

৬. আমানত ও ঋণ পরিশোধ:
তিনি বলেন, “ঋণ অবশ্যই ফেরত দিতে হবে। বিশ্বস্ততার সাথে প্রত্যেকের আমানত রক্ষা করতে হবে। কারো সম্পত্তি সে যদি স্বেচ্ছায় না দেয়, তবে তা অপর কারো জন্য হালাল নয়। তোমরা কেউ দুর্বলের উপর অবিচার করো না।”

৭. জ্ঞান অর্জন ও শ্রেষ্ঠত্ব:
মুহাম্মদ (সা:) বলেন, “জ্ঞানীর কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়েও মূল্যবান। জ্ঞান অর্জন প্রত্যেক নর-নারীর জন্য ফরয—কারণ জ্ঞান মানুষকে সঠিক পথ দেখায়। জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রয়োজনে তোমরা চীনে যাও।” বংশগত শ্রেষ্ঠত্ব বাতিল করে তিনি বলেন, কুলীন বা শ্রেষ্ঠ সেই যে বিশ্বাসী ও মানুষের উপকার করে।

৮. আনুগত্য ও ধর্মীয় অনুশাসন:
তিনি মুসলিম উম্মাহকে নির্দেশ দেন, “তোমরা তোমাদের প্রভুর ইবাদত করবে, নামায কায়েম করবে, যাকাত আদায় করবে, রোজা রাখবে, হজ্ব করবে আর সংঘবদ্ধভাবে নেতাকে অনুসরণ করবে, তাহলে তোমরা জান্নাতে দাখিল হতে পারবে।”

৯. নেতা নির্বাচন ও আনুগত্য:
তিনি বলেন, “শুনে রাখো একজন কুশ্রী-কদাকার ব্যক্তিও যদি তোমাদের নেতা মনোনীত হয়, যতদিন পর্যন্ত সে আল্লাহর কিতাব অনুসারে তোমাদের পরিচালিত করবে, ততদিন পর্যন্ত তার আনুগত্য করা তোমাদের অবশ্য কর্তব্য।”

১০. ইসলাম ধর্মের উৎস:
তিনি বলেন, “শুনে রাখো আমার পর আর কোনো নবী নেই। হে মানুষ আমি তোমাদের কাছে দুটি আলোকবর্তিকা রেখে যাচ্ছি। যতদিন তোমরা এ দুটো অনুসরণ করবে ততদিন তোমরা সত্য পথে থাকবে। এর একটি হলো—আল্লাহর কিতাব, দ্বিতীয়টি হলো—আমার জীবন-দৃষ্টান্ত।”

ভাষণের শেষে তিনি জনতার উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করলেন, “হে মানুষ আমি কি তোমাদের কাছে আল্লাহর বাণী পৌঁছে দিয়েছি?” সকলে সমস্বরে জবাব দিলো: “হ্যাঁ”। এরপর নবীজী (স:) বললেন: “হে আল্লাহ তুমি সাক্ষী থাকো! আমি আমার সকল দায়িত্ব পালন করেছি।”

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button