বিশ্লেষণস্বাস্থ্য

ষাটোর্ধ্বদের জন্য জরুরি: এক পতন কেড়ে নিতে পারে দশ বছর

হাড় ভাঙা ঠেকাতে “সাবধান, সাবধান, সবসময় সাবধান!” নীতি মেনে চলুন

স্বাস্থ্য ডেস্ক: ষাট বছর বা তার কাছাকাছি বয়সের মানুষের জন্য অত্যন্ত জরুরি একটি তথ্য প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, এই বয়সের মানুষের জন্য হাড়ের ঘনত্ব (Bone Density) পরীক্ষা করানো অর্থহীন। কারণ, বয়োবৃদ্ধদের মধ্যে অস্টিওপোরোসিস (Osteoporosis) থাকাটা অনিবার্য। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এর মাত্রা বাড়তে থাকে, যা স্বাভাবিকভাবেই হাড় ভাঙ্গার ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়।

চিকিৎসকদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, বেশি বয়সী যেসব মানুষ পড়ে গিয়ে গুরুতর আঘাত পান, তাদের মধ্যে মৃত্যুর প্রবণতা অনেক বেশি দেখা যায়। পড়ে যাওয়ার ফলে সব সময় হাড় না ভাঙলেও, পতনের দৈহিক ও মানসিক যে আঘাত বা ঝাঁকুনি তৈরি হয়, তা শরীর-মনকে মারাত্মকভাবে পর্যুদস্ত করে দেয়। এই ধকল সামলাতে না পেরেই অনেক সময় রোগী মৃত্যুর দিকে ধাবিত হয়। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, একবার পড়ে গিয়ে বড় ধরনের আঘাত পেলে গড় আয়ু প্রায় দশ বছর কমে যেতে পারে। বৃদ্ধ বয়সে কোনো বড় অপারেশন ভালো ফল দেয় না, আর ওষুধ খেয়ে বিছানায় শুয়ে চিকিৎসা নেওয়া মানে কেবল মৃত্যুর দিন গোনা। তাই সাবধান থাকার কোনো বিকল্প নেই।

যাদের বয়স ষাট পেরিয়ে গেছে, তাদের ক্ষেত্রে হাড় ভাঙ্গা ঠেকানোর সবচেয়ে বড় উপায় হলো যেকোনো ধরনের পতন বা পড়ে যাওয়া রোধ করা। এই গোপন রহস্যকে চারটি শব্দে প্রকাশ করা যায়: “সাবধান, সাবধান, সবসময় সাবধান!”

এই সতর্কতা অবলম্বনের জন্য দৈনন্দিন জীবনে যে বিষয়গুলোতে অতিরিক্ত নজর দেওয়া প্রয়োজন, সেগুলো নিচে বিস্তারিত তুলে ধরা হলো:

১. বাথরুম ও শৌচাগারে সর্বোচ্চ সতর্কতা:

  • এই বয়সে কোমরের হাড় ভাঙ্গার এক নম্বর কারণ হলো বাথরুমে পা পিছলে পড়ে যাওয়া। তাই স্নান বা বাথরুম ব্যবহারের সময় অতিরিক্ত সতর্ক থাকতে হবে।
  • বাথরুমে ঢোকার আগে মেঝে ভেজা কিনা, তা ভালো করে দেখে নিন। ভেজা মেঝেতে হাঁটা পরিহার করুন।
  • কমোড ব্যবহারের চেষ্টা করুন। হাঁটু ভাঁজ করে বসলে ওঠার সময় বেশি বেগ পেতে হয় এবং পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।
  • কমোড থেকে ওঠার সময় হাতে ভর দেওয়ার জন্য দেওয়ালে হাতল লাগিয়ে নিন।
  • স্নানের সময় বসার জন্য টুল ব্যবহার করুন। চোখ বন্ধ করে মাথায় পানি দেওয়া থেকে বিরত থাকুন।
  • বিশেষ করে বয়স্ক নারীরা, বাথরুমে দাঁড়িয়ে কাপড় বদলাবেন না। স্নান শেষে তোয়ালে বা শাড়ি পেঁচিয়ে বেরিয়ে আসুন এবং ধীরে সুস্থে চেয়ার বা বিছানায় বসে পোশাক পরিধান করুন।

২. ঘরের ভেতরে ও সিঁড়িতে সতর্কতা:

  • কোনো কিছু ধরতে বা নামাতে চেয়ার বা টুল জাতীয় কিছুর ওপর উঠে দাঁড়াবেন না।
  • রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে ঘরের মেঝেতে কিছু পড়ে আছে কিনা, তা ভালো করে দেখে নিন যাতে পা লেগে হোঁচট খেতে না হয়। মেঝে যেন অবশ্যই ভেজা না থাকে, সে ব্যাপারে অতিরিক্ত সতর্ক থাকুন।
  • রাতে ঘুম ভাঙলে বিছানা ছাড়ার আগে ২-৩ মিনিট বিছানার পাশে বসুন, বাতি জ্বালান, এরপর উঠে দাঁড়ান।
  • রাতে বাথরুমের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করবেন না। সম্ভব হলে ভেতরে একটি অ্যালার্ম লাগিয়ে নিন, যাতে জরুরি মুহূর্তে বেল বাজিয়ে সাহায্য চাওয়া যায়।
  • বেশি বয়সে কখনো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাপড় বদলাবেন না। চেয়ার বা বিছানায় বসে নিন।
  • সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় সব সময় রেলিংয়ে একটা হাত রাখুন। দুই হাত পকেটে ঢুকিয়ে সিঁড়িতে পা রাখবেন না।
  • যদি কখনো পড়েই যেতে থাকেন, চেষ্টা করুন হাত প্রসারিত করে মাটি বা মেঝে ধরে ফেলতে—এতে হাত ভাঙলেও তা কোমর ভাঙার চেয়ে অনেক বেশি নিরাপদ।

৩. দৈনন্দিন জীবন ও খাদ্যাভ্যাস:

  • বৃষ্টির দিনে বাইরে হাঁটতে যাওয়া এড়িয়ে চলুন।
  • সারাদিন শুয়ে বসে না থেকে অন্তত কিছু মিনিটের জন্য নিয়মিত হাঁটুন—যতটা সম্ভব।
  • বিশেষ করে মহিলারা, ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখার ব্যাপারে যত্নবান হোন। পরিমিত খাবার খাওয়া এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বেঁচে যাওয়া খাবার নষ্ট না করে খেয়ে ফেলার প্রবণতা পরিহার করুন। কখনো ভরপেট খাবেন না, সবসময় পেট ভরার আগেই খাওয়া শেষ করুন।
  • সম্ভব হলে বাইরে রোদে কিছু কাজ করুন। ভিটামিন ডি-এর প্রভাবে হাড় কিছুটা শক্ত হবে।

চিকিৎসকরা জোর দিয়ে বলেছেন, বৃদ্ধ বয়সে একবার পড়ে যাওয়া বা বড় ধরনের আঘাত পাওয়ার পর কোনো অপারেশন বা ওষুধ খেয়ে বিছানায় শুয়ে থাকা কেবল মৃত্যুর দিন গোনার শামিল। তাই সাবধানতার কোনো বিকল্প নেই। যারা বয়োবৃদ্ধদের সেবা করছেন, তাদেরও এই বিষয়গুলো মাথায় রাখা অত্যন্ত জরুরি।

(মূল লেখক: ডা. রামবিলাস মালানি, নাগপুর। পরিমার্জিত ও প্রকাশিত)

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button