বিশ্লেষণস্বাস্থ্য

সুপারি: পানীয় অনুষঙ্গ নাকি নীরব ঘাতক? স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের চরম সতর্কতা

স্বাস্থ্য ডেস্ক: অতিথি আপ্যায়নে পান-সুপারি বাংলাদেশের সংস্কৃতির এক অপরিহার্য অনুষঙ্গ। তবে অনেকের কাছে এটি আসক্তির রূপ নিয়েছে। ঐতিহ্য ও ব্যবসার দিক থেকে ভারত, মিয়ানমার এবং ইন্দোনেশিয়ার পর বাংলাদেশ বিশ্বে চতুর্থ সুপারি উৎপাদনকারী দেশ হলেও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সুপারিকে মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

স্বাস্থ্য ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞগণ সুপারি গ্রহণ, এমনকি এর চাষাবাদ ও বিপণন সম্পূর্ণরূপে বর্জন করার জন্য সতর্কবার্তা দিয়েছেন। এই প্রসঙ্গে ইবনে সিনা হাসপাতালের হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ প্রফেসর কর্নেল ডঃ জেহাদ খান তাঁর লিখিত প্রবন্ধে সুপারির মারাত্মক ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরেছেন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সুপারির উপকারিতা নিয়ে কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণা না হলেও এর অপকারিতার ওপর বহু গবেষণা হয়েছে। যদিও অনেকে মনে করেন, পান-সুপারি খেলে শরীর উষ্ণ হয় এবং কর্মদক্ষতা ও মনের সতর্কতা বাড়ে (যেমন চালকরা ঘুম তাড়াতে পান গ্রহণ করেন), কিন্তু এটি একটি ভুল ধারণা।

আশ্চর্যজনকভাবে, অনেক রোগী সিগারেট ছাড়তে পারলেও পানের নেশা বা আসক্তি ত্যাগ করতে পারেন না। সমাজে অনেক ক্ষেত্রে দাঁত নড়বড়ে বা না থাকলেও হামান দিস্তা দিয়ে গুঁড়ো করে হলেও পান-সুপারি খাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়।

তবে, পান খাওয়ার সময় সুপারি, চুন, খয়ের, জর্দা, লবঙ্গসহ যে উপাদানগুলো ব্যবহার করা হয়, তার বেশির ভাগই স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক।

সুপারির মধ্যে অ্যারেকোলিন (Arecoline), অ্যারেকাইডিন (Arecaidine) ও গাভাকাইন (Gavacaine)-এর মতো ক্ষারজাতীয় উপাদান বিদ্যমান, যা মানবদেহের রক্তনালীগুলোকে সংকুচিত করে দেয়।

এছাড়াও, সুপারিতে থাকা অ্যাডরেনালিনের কারণে নিয়মিত ও অতিরিক্ত সুপারি সেবনে রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া, বুক ধড়ফড় করা, ডায়াবেটিস বৃদ্ধি পাওয়া, হাঁপানির প্রকোপ বৃদ্ধি এবং হৃদরোগের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। কাঁচা সুপারি চিবালে তাৎক্ষণিক শরীরে গরম অনুভূত হওয়া, এমনকি ঘাম হওয়া এবং মাথা ঘোরার মতো সমস্যাও দেখা যায়, যা ০.১-০.৫% অ্যালকালয়েডের কারণে ঘটে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সুপারি প্রতিটি অঙ্গের ক্ষতি করতে পারে। লিভার ইনজুরি, কিডনি রোগ, বিপিএইচ (BPH), বন্ধ্যাত্ব (Infertility), হাইপারলিপিডোমিয়া, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস, মানসিক রোগ বৃদ্ধি পাওয়া, দাঁতের মাড়ি ক্ষয়ে যাওয়া এবং দাঁত পড়ে যাওয়ার মতো সমস্যার সঙ্গে সুপারি সরাসরি যুক্ত। সুপারির সাথে স্থূলতা (Obesity) এবং মেটাবলিক সিন্ড্রোমের সংযোগ পাওয়া গেছে।

গর্ভবতী মায়েদের ক্ষেত্রে সুপারি সেবন অকালে সন্তান প্রসব (Preterm birth) এবং সন্তানের ওজন ও উচ্চতা কম হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়।

সুপারির সঙ্গে ক্যান্সারের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এবং আন্তর্জাতিক ক্যান্সার গবেষণা সংস্থা (IARC) ১৯৮৫ সাল থেকেই সুপারিকে সরাসরি ‘কার্সিনোজেন’ (ক্যান্সার সৃষ্টিকারী উপাদান) হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। ২০০৯ সালে ৩০ জন বিজ্ঞানী IARC-এর কাছে সুপারিতে ক্যান্সার জীবাণুর উপস্থিতি নিশ্চিত করেন।

পৃথিবীর যেসকল অঞ্চলে সুপারি ব্যবহারের ব্যাপকতা বেশি, বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশে, সেখানে মুখের ও খাদ্যনালীর ক্যান্সার অত্যন্ত বেশি দেখা যায়। এই অঞ্চলে প্রতি এক লাখ লোকের মধ্যে ২০ জন এই ক্যান্সারে আক্রান্ত হন এবং সব ধরনের ক্যান্সারের মধ্যে শতকরা ৩০ ভাগই মুখের ও খাদ্যনালীর ক্যান্সার।

যুক্তরাষ্ট্রের নির্ভরযোগ্য গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠান সিডিসি (CDC)-এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে মৃত্যুর প্রধান কারণগুলোর মধ্যে ক্যান্সার অন্যতম। সিডিসি আরও জানায়, সুপারির সঙ্গে মুখের ক্যান্সার (Oral cancer), ওরাল সাবমিউকাস ফাইব্রোসিস, আসক্তি ও প্রজনন সমস্যা জড়িত।

অপরদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান এফডিএ (FDA) সুপারিকে বিষাক্ত গাছের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে এবং এটি চিবানো বা খাওয়ার জন্য মোটেও নিরাপদ নয় বলে মনে করে।

এদিকে, ঢাকা ট্রিবিউনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক ক্যান্সার গবেষণা সংস্থা আইএআরসি-এর মতে, যারা পানের সাথে তামাকজাতীয় দ্রব্য গ্রহণ করেন, তাদের সাধারণের চেয়ে পাঁচগুণ বেশি ওরাল ক্যান্সার হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

উন্মুক্ত বিশ্বকোষ উইকিপিডিয়ার তথ্যানুসারে, যদিও আধুনিক গবেষণা সুপারিকে ক্ষতিকর ও নেশা উদ্রেককারী বলে নিশ্চিত করেছে, তবে ঐতিহ্যগতভাবে এটি কৃমি, রক্ত আমাশয় এবং অজীর্ণ (Indigestion) নিরাময়ে উপকারী হিসেবে বিবেচিত ছিল। প্রতি ১০০ গ্রাম সুপারিতে ২৮৯ ক্যালরি শক্তি যোগানোর ক্ষমতা রয়েছে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button