জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মানবতাবিরোধী অপরাধে সাজা; আসাদুজ্জামান খান কামালও দোষী সাব্যস্ত; রাজসাক্ষী হওয়ায় মামুনের কম সাজা
অপরাধ বিচিত্রা ডেস্ক: ২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড এবং আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। সোমবার (১৭ নভেম্বর) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারপতি গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল এই ঐতিহাসিক রায় ঘোষণা করেন।
মামলায় আনীত দুই নম্বর অভিযোগে শেখ হাসিনাকে সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এছাড়া, এক নম্বর অভিযোগে তাকে আমৃত্যু কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। রায়ে আদালত উল্লেখ করেন যে, শেখ হাসিনা মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন।
আদালত আরও জানান, এই মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধেও মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রমাণ মিলেছে। তবে চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন রাজসাক্ষী (অ্যাপ্রুভার) হয়ে ঘটনার সত্য উন্মোচন করায়, তার অপরাধের সাজা সর্বোচ্চ হলেও সত্য উদঘাটনে সহায়তার জন্য সাজা কম হবে।
বেলা সাড়ে ১২টার দিকে রায় ঘোষণা শুরু হয় এবং আদালত ৪৫৩ পৃষ্ঠার এই রায়ের সংক্ষিপ্ত অংশ পাঠ করেন।
গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় প্রথম মামলাটি (মিসকেস) দায়ের হয় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। ১৭ অক্টোবর পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালের প্রথম বিচারকাজেই শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়।
প্রাথমিকভাবে শেখ হাসিনা একমাত্র আসামি থাকলেও, চলতি বছরের ১৬ মার্চ প্রসিকিউশনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ মামলায় সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে আসামি করা হয়।
২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের সময়কার মানবতাবিরোধী অপরাধে প্রসিকিউশন মোট পাঁচটি অভিযোগ আনে। ১২ মে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা ৮ হাজার ৭৪৭ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন জমা দেয়। এরপর ১ জুন হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান ও আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হলে ট্রাইব্যুনাল তা আমলে নেন। ১০ জুলাই তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেওয়া হয়।
পরবর্তীকালে সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের দোষ স্বীকার এবং রাজসাক্ষী হওয়ার আবেদন মঞ্জুর করেন ট্রাইব্যুনাল। তিনি এ মামলার রাজসাক্ষী হয়ে সাক্ষ্য দেন।
গত ২৩ অক্টোবর মামলার সমাপনী বক্তব্যে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খানের সর্বোচ্চ শাস্তি প্রার্থনা করেন। চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলামও একই দাবি জানান। তবে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন তাদের খালাস প্রার্থনা করেন। গত ১৩ নভেম্বর রায় ঘোষণার তারিখ জানানো হয়।
১. প্রথম অভিযোগ: গত বছরের ১৪ জুলাই গণভবনের সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারী ছাত্র-ছাত্রীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ ও ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ বলে শেখ হাসিনার উসকানিমূলক বক্তব্যের ফলস্বরূপ আসাদুজ্জামান খান, চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনসহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্ররোচনা, সহায়তা ও সম্পৃক্ততায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সশস্ত্র আওয়ামী সন্ত্রাসীরা ব্যাপক মাত্রায় নিরীহ-নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর আক্রমণ করে। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রায় দেড় হাজার ছাত্র-জনতাকে হত্যা এবং ২৫ হাজার জন আহত হন।
২. দ্বিতীয় অভিযোগ: হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের নির্মূল করার নির্দেশ দেন শেখ হাসিনা। ১৪ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য এবং ১৮ জুলাই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়রের সঙ্গে কথোপকথনের অডিও রেকর্ডের মাধ্যমে জানা যায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে মারণাস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। সেই নির্দেশ তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপির মাধ্যমে কার্যকর হওয়ায় মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়। এই অভিযোগে সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটির (সর্বোচ্চ দায়) আওতায় তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠিত হয়।
৩. তৃতীয় থেকে পঞ্চম অভিযোগ: এছাড়াও, রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যা; রাজধানীর চানখাঁরপুলে নিরীহ-নিরস্ত্র ছয়জনকে গুলি করে হত্যা; এবং আশুলিয়ায় নিরীহ-নিরস্ত্র ছয়জনকে হত্যার পর আগুনে পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় শেখ হাসিনাসহ তিনজনকে অভিযুক্ত করা হয়।



