অপরাধএক্সক্লুসিভদুর্নীতিপ্রতারনাপ্রশাসনবাংলাদেশসম্পাদকীয়

ফারইস্টের অর্থ আত্মসাৎ; সাবেক সিইও হেমায়েত গ্রেফতার

নিজস্ব প্রতিবেদক: গ্রাহকের আমানত ও কোম্পানির তহবিল থেকে ৮১৬ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের সাবেক মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হেমায়েত উল্লাহকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।

গত মঙ্গলবার (১৮ নভেম্বর ২০২৫) বিকেলে রাজধানীর একটি এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। বুধবার (১৯ নভেম্বর) তাকে আদালতে হাজির করা হলে বিচারক জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। ডিবি সূত্র নিশ্চিত করেছে যে, গ্রেফতারের পর হেমায়েত উল্লাহ আদালতে নিজের দোষ স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন।

২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের আইন কর্মকর্তা মো. জসিম উদ্দিন বাদী হয়ে শাহবাগ থানায় এই মামলাটি দায়ের করেন। মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়, কোম্পানির সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম ও সাবেক পরিচালক এম এ খালেকের সঙ্গে যোগসাজশ করে হেমায়েত উল্লাহ বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। মামলাটি বর্তমানে ডিবির তদন্তাধীন রয়েছে।

বিমা খাতের সংশ্লিষ্টরা জানান, ফারইস্ট ইসলামী লাইফ একসময় ভালো মানের কোম্পানি হিসেবে পরিচিত ছিল। তবে একটি বিশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উঠে আসে ভয়াবহ দুর্নীতির চিত্র। প্রতিবেদন অনুযায়ী, কোম্পানিটি থেকে মোট ২ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এর বাইরে আরও ৪৩২ কোটি টাকার আর্থিক অনিয়মের প্রমাণ মিলেছে। মূলত কোম্পানির শীর্ষ তিন ব্যক্তি—সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম, পরিচালক এম এ খালেক এবং সিইও হেমায়েত উল্লাহর নেতৃত্বেই এই লুটপাট সংঘটিত হয়।

নিরীক্ষা প্রতিবেদন বলছে, মূলত তিনটি উপায়ে এই বিপুল অর্থ সরিয়ে নেওয়া হয়েছে— ১. বাজারমূল্যের চেয়ে অস্বাভাবিক বেশি দামে জমি ক্রয়, ২. ব্যাংকে থাকা কোম্পানির স্থায়ী আমানত (এমটিডিআর) বন্ধক রেখে পরিচালকদের ঋণ গ্রহণ এবং ৩. ক্ষতিকর খাতে বিনিয়োগ।

২০১৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত দেশের ১৪টি স্থানে জমি কেনে ফারইস্ট। এসব জমিতে ভুয়া উচ্চমূল্য দেখিয়ে ৬৬৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়। এর মধ্যে মিরপুরের গোড়ান চটবাড়ি এলাকার ৭৮৬ শতাংশ জমি ১৯ কোটি টাকায় কেনা হলেও নথিপত্রে দাম দেখানো হয় ১৯৯ কোটি টাকা। এই বাড়তি টাকার মধ্যে ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং, কেডিসি কনস্ট্রাকশন ও মাহবুবা অ্যাসোসিয়েটকে চেকের মাধ্যমে ৪০ কোটি টাকা এবং বাকি অর্থ নগদে লেনদেন দেখানো হয়। একইভাবে ৭২ কাকরাইলের জমি কেনায় ১৬০ কোটি এবং গুলশানের একাধিক প্লট কেনায় প্রায় ১৬৯ কোটি টাকা সরিয়ে ফেলা হয়।

দলিল পর্যালোচনায় দেখা যায়, কাকরাইলের জমিটি কেনা হয়েছিল সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলামের শ্বশুর ও শ্যালকের কাছ থেকে। জমি বিক্রির পর সেই টাকা আবার উপহার হিসেবে নজরুল ইসলামের স্ত্রীর অ্যাকাউন্টে এবং পরবর্তীতে নজরুলের অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করা হয়। এছাড়া আইন লঙ্ঘন করে জমির মালিকদের বিপুল পরিমাণ অর্থ নগদে পরিশোধ দেখানো হয়েছে।

কোম্পানির এমটিডিআর বা ফিক্সড ডিপোজিট বন্ধক রেখে ১ হাজার ৩৩২ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করেন পরিচালকরা। এর মধ্যে প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটি, পিএফআই প্রোপার্টিজ, মিথিলা টেক্সটাইলসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে এই অর্থ বের করে নেওয়া হয়।

এছাড়া অস্তিত্বহীন ও দুর্বল প্রতিষ্ঠানে ‘ক্ষতিকর বিনিয়োগ’ দেখিয়ে সরিয়ে নেওয়া হয় আরও ২৮৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাংলালায়ন কনভার্টেবল বন্ডে ১৪০ কোটি এবং পিএফআই সিকিউরিটিজে ১৩২ কোটি টাকা বিনিয়োগের নামে লোপাট করা হয়েছে। এমনকি কর্মকর্তাদের নামে ভুয়া ব্যাংক হিসাব খুলে ৮৪ কোটি টাকা আত্মসাতের প্রমাণও মিলেছে তদন্তে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button