নিজস্ব প্রতিবেদক: আজ ভূমিকম্পের পরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যক্তিগত বা ঘরের ভেতরের সিসিটিভি ফুটেজ শেয়ার করার হিড়িক পড়েছে। আতঙ্ক বা অভিজ্ঞতার মুহূর্ত সবার সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া স্বাভাবিক মনে হলেও, নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা একে দেখছেন বড় ধরনের ঝুঁকি হিসেবে। তাঁরা বলছেন, নিছক ‘কনটেন্ট’ বা ভিডিও মনে করে যা শেয়ার করা হচ্ছে, তা আসলে নিজের এবং পরিবারের নিরাপত্তার চাদর জনসমক্ষে ছিঁড়ে ফেলার শামিল।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ঘরের ভেতরের ভিডিও ফুটেজ পাবলিক প্ল্যাটফর্মে প্রকাশ করার মাধ্যমে মানুষ অজান্তেই তার বাসস্থানের ‘লেআউট’ বা নকশা উন্মুক্ত করে দিচ্ছে। ভিডিওতে দৃশ্যমান দরজা-জানালা, লকার, সুইচবক্স কিংবা মূল্যবান আসবাবপত্রের অবস্থান অপরাধীদের জন্য একটি ‘ভালনারেবিলিটি ম্যাপিং’ বা দুর্বলতার মানচিত্র হিসেবে কাজ করে। কোনো বাড়তি নজরদারি ছাড়াই অপরাধী চক্র এই ফুটেজ বিশ্লেষণ করে চুরির ছক বা পালানোর পথ সহজেই ঠিক করে নিতে পারে। নিরাপত্তা পরিভাষায়, মানুষ নিজেই নিজের ঘরকে ‘ওপেন সোর্স ডেটা’র উৎসে পরিণত করছে।
সমাজবিজ্ঞানীরা এই প্রবণতাকে ‘সার্ভিল্যান্স নরমালাইজেশন’ বা নজরদারিকে স্বাভাবিকীকরণের প্রক্রিয়া হিসেবে অভিহিত করছেন। আগে যে দৃশ্যগুলো একান্তই ব্যক্তিগত বা পারিবারিক পরিসরে সীমাবদ্ধ ছিল, তা এখন সামাজিক মাধ্যমের কনটেন্টে পরিণত হয়েছে। ফুটেজে পরিবারের সদস্যদের চলাফেরা, শিশুদের অবস্থান, কে কোন রুমে থাকে, এমনকি ঘুমের রুটিনও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই তথ্যগুলো ‘ক্রিমিনাল ইন্টেলিজেন্স’ বা অপরাধীদের গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের কাজকে অত্যন্ত সহজ করে দেয়।
শুধু দৃশ্যমান ছবিই নয়, এসব ভিডিওর নেপথ্যে থাকা অদৃশ্য তথ্য বা ‘মেটাডেটা’ও সমান ঝুঁকিপূর্ণ। ক্যামেরার ব্র্যান্ড, মডেল, ভিডিওর সময় (টাইম স্ট্যাম্প) এবং ধারণ করার অ্যাঙ্গেল—এসব তথ্য বিশ্লেষণ করে হ্যাকাররা সহজেই ক্যামেরার নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেদ করতে পারে। ভিডিওর সময় দেখে বোঝা সম্ভব, দিনের কোন সময়ে পরিবারের সদস্যরা ঘরে থাকেন না কিংবা কখন তারা সবচেয়ে বেশি অপ্রস্তুত থাকেন। এই ‘মেটাডেটা লিকেজ’ ভবিষ্যতে টার্গেটেড ক্রাইম বা সুনির্দিষ্ট অপরাধ সংঘটনে ব্যবহৃত হতে পারে।
ভূমিকম্পের মতো বিপর্যয়ের সময় মানুষ নিজের নিরাপত্তা প্রমাণ করতে বা সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয় থাকতে এসব ভিডিও পোস্ট করে। একে বলা হয় ‘পার্টিসিপেটরি সার্ভিল্যান্স’ বা অংশগ্রহণমূলক নজরদারি। মানুষ নিজের অজান্তেই নিজেকে নজরদারির আওতায় নিয়ে আসে, যা দীর্ঘমেয়াদে একটি নজরদারি-নির্ভর সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখে।
এছাড়া, আরেকটি বড় ঝুঁকি হলো ‘সার্ভিল্যান্স ক্যাপিটালিজম’ বা নজরদারি পুঁজিবাদের বিস্তার। সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলো এসব ফুটেজ থেকে ডেটা স্ক্র্যাপ করে তাদের ফেস রিকগনিশন অ্যালগরিদম এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে (AI) প্রশিক্ষণ দেয়। অর্থাৎ, ব্যবহারকারী না বুঝেই নিজের ও পরিবারের বায়োমেট্রিক তথ্য এবং আচরণগত প্যাটার্ন করপোরেট ডেটাবেসে তুলে দিচ্ছেন।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা পরামর্শ দিয়েছেন, দুর্যোগকালীন সময়ে আবেগ বা আতঙ্কের বশবর্তী হয়ে এমন ফুটেজ শেয়ার করা থেকে বিরত থাকতে। কারণ, ক্ষণিকের লাইক বা শেয়ারের চেয়ে পরিবারের দীর্ঘমেয়াদী নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা রক্ষা করা অনেক বেশি জরুরি।



