নিজস্ব প্রতিবেদক: জুলাই বিপ্লবের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আমূল বদলে গেছে। পরিবর্তিত এই পরিস্থিতিতে প্রথাগত রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্বের মানদণ্ড নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে শুরু হয়েছে চুলচেড়া বিশ্লেষণ। বিশেষ করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের রাজনৈতিক যোগ্যতা, অতীত ভূমিকা এবং বর্তমান নেতৃত্ব নিয়ে নানা মহলে জোরালো প্রশ্ন উঠছে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ও সচেতন মহলের আলোচনায় তারেক রহমানের নেতৃত্বের সীমাবদ্ধতা হিসেবে মূলত কয়েকটি বিষয় বারবার উঠে আসছে।
নেতৃত্বের অন্যতম ভিত্তি হলো শিক্ষা ও পেশাগত দক্ষতা। সমালোচকদের মতে, তারেক রহমানের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। পাবলিক ডোমেইনে থাকা তথ্য ও উইকিপিডিয়া সূত্রমতে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির তথ্য পাওয়া গেলেও তাঁর স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। তিনি মূলত উচ্চমাধ্যমিক (ইন্টারমিডিয়েট) পাস হিসেবেই পরিচিত। এ ছাড়া, রাজনীতিতে পূর্ণমাত্রায় সক্রিয় হওয়ার আগে বা দীর্ঘ প্রবাস জীবনে তিনি কোনো পেশাগত চাকরি বা ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন—এমন কোনো রেকর্ড নেই। জীবনযাপনের ব্যয় নির্বাহে তাঁর আয়ের উৎস কী, তা নিয়েও গত দেড় যুগে কোনো স্পষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। লন্ডনের মতো ব্যয়বহুল শহরে তিনি চাকরি বা ব্যবসা করছেন, নাকি অন্য কোনো সুবিধায় চলছেন, তা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন রয়েই গেছে।
গত ১৭ বছর ধরে লন্ডনে অবস্থান করলেও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বিগত সরকারের বিরুদ্ধে শক্তিশালী কোনো জনমত বা ন্যারেটিভ তৈরি করতে পারেননি তিনি। অক্সফোর্ড বা ক্যামব্রিজের মতো বিশ্বখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাছাকাছি থেকেও সেখানকার বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজের সঙ্গে তাঁর কোনো সংযোগ স্থাপিত হয়নি। সমালোচকরা বলছেন, দীর্ঘ নির্বাসিত জীবনে তিনি নিজেকে একজন আন্তর্জাতিক মানের নেতা হিসেবে গড়ে তোলার সুযোগ কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছেন।
তারেক রহমানের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের শুরু এবং অতীত ভূমিকা নিয়েও রয়েছে সমালোচনা। ১৯৯০ সালের এরশাদবিরোধী গণআন্দোলনের সময় তিনি ২৫ বছরের যুবক ছিলেন। সেই সময় তাঁর মা বেগম খালেদা জিয়া রাজপথে আপসহীন সংগ্রাম করলেও, তারেক রহমানকে আন্দোলনের মাঠে দেখা যায়নি। তিনি রাজনীতিতে দৃশ্যমান হন ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর। অভিযোগ রয়েছে, মায়ের ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে তিনি দলের নিয়ন্ত্রণ নেন, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে দলের সাংগঠনিক কাঠামো ও রাষ্ট্র পরিচালনায়।
জুলাই বিপ্লব-পরবর্তী বাংলাদেশে কেবল পারিবারিক পরিচয় বা ‘লিগ্যাসি’ দিয়ে রাজনীতি করার দিন শেষ হয়ে আসছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। ডাকসু বা জাকসুর মতো ছাত্র সংসদ নির্বাচনগুলোর ফলাফলেও এর প্রতিফলন দেখা গেছে। বর্তমান প্রজন্মের কাছে ব্যক্তিগত অর্জনহীন নেতৃত্বের গ্রহণযোগ্যতা তলানিতে।
বিশ্লেষকদের মতে, একজন নেতার মান বোঝা যায় তাঁর পারিপার্শ্বিকতা বা উপদেষ্টাদের দেখে। লিওনেল মেসির পাশে যেমন সমমানের খেলোয়াড়রা থাকেন, তেমনি রাজনৈতিক নেতৃত্বের আশপাশেও মেধাবীদের থাকাটা জরুরি। কিন্তু তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ বলয়ে যাঁদের দেখা যায়, তাঁদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। মির্জা আব্বাস বা শামসুজ্জামান দুদুর মতো নেতাদের ওপর নির্ভরতা এবং ছাত্রনেতা নামধারী বিতর্কিত চরিত্রদের উপস্থিতি তাঁর নেতৃত্বের সীমাবদ্ধতাকেই ইঙ্গিত করে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, জুলাই-পরবর্তী বাংলাদেশে নেতৃত্ব দিতে হলে কেবল পারিবারিক পরিচয় যথেষ্ট নয়; প্রয়োজন মেধা, ত্যাগ এবং স্বচ্ছ পেশাগত জীবনের দৃষ্টান্ত। সে ক্ষেত্রে তারেক রহমান কতটুকু প্রাসঙ্গিক থাকতে পারবেন, তা সময় ও তাঁর পরবর্তী কর্মকাণ্ডই বলে দেবে।



