অর্থনীতিদেশবাংলাদেশমিডিয়াসম্পাদকীয়

মৎস্য শ্রমিকদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি ও আইনি সুরক্ষা নিশ্চিতের আহ্বান

নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশের মৎস্যখাতের বিশাল জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা চরম ঝুঁকির মুখে রয়েছে। প্রায় এক কোটি ২০ লাখ মানুষ এই খাতের সরবরাহ শৃঙ্খলের সঙ্গে যুক্ত এবং ১৪ লাখ মানুষ সরাসরি মৎস্য আহরণের ওপর নির্ভরশীল। অথচ এই বিপুল সংখ্যক শ্রমিকের জন্য নেই কোনো কার্যকর আইনি সুরক্ষা বা পর্যাপ্ত সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি। মৎস্য শ্রমিকদের অবিলম্বে শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান, পরিচয়পত্র নিশ্চিতকরণ এবং ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে আয়োজিত এক জাতীয় সংলাপে বক্তারা এসব কথা বলেন।

মঙ্গলবার (২৫ নভেম্বর ২০২৫) রাজধানীর দ্য ডেইলি স্টার সেন্টারে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস)-এর উদ্যোগে এবং ফ্রেডরিখ-ইবার্ট-স্টিফটুং (এফইএস)-এর সহায়তায় ‘মৎস্য শ্রমিকদের আইনি অধিকার ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ’ শীর্ষক এই সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়।

সংলাপে বক্তারা অভিযোগ করেন, বিদ্যমান শ্রম আইনে কেবল ফিশিং ট্রলার ও মৎস্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের শ্রমিকদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর বাইরে বিশাল সংখ্যক মৎস্য শ্রমিক আইনি সুরক্ষার আওতার বাইরে রয়ে গেছেন। চিংড়ি ও ট্রলার শিল্প ছাড়া অন্য কোনো ক্ষেত্রে শ্রমিকদের জন্য নির্দিষ্ট মজুরি কাঠামো নেই। ফলে তারা ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

মূল প্রবন্ধে বিলসের উপ-পরিচালক অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম গবেষণালব্ধ ফলাফল তুলে ধরে বলেন, নিয়োগপত্র, কর্মঘণ্টা, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা, চিকিৎসা কিংবা ক্ষতিপূরণের মতো মৌলিক বিষয়গুলোতে শ্রম আইনের কোনো তোয়াক্কা করা হয় না। অধিকাংশ শ্রমিক দাদন ও ঋণের জালে আটকা পড়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

আলোচকরা বলেন, সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে শ্রমিকরা প্রতিনিয়ত ঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও জলদস্যুদের কবলে পড়েন। অথচ তাদের সুরক্ষায় আধুনিক সিগন্যাল সিস্টেম বা জীবনরক্ষার সরঞ্জাম নেই। ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম (পিপিই) সরবরাহ করা হয় না। এছাড়া মাছ ধরার ওপর সরকারি নিষেধাজ্ঞার সময় যে সহায়তা দেওয়া হয়, তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগণ্য। প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট কারণে নদীতে মাছ কমে যাওয়ায় শ্রমিকদের আয়ও কমে গেছে।

সংলাপে মৎস্য শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে বেশ কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে রয়েছে—
১. আইএলও কনভেনশন-১৮৮ ও জাতীয় সংবিধানের আলোকে মৎস্য শ্রমিকদের পূর্ণাঙ্গ শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি ও পরিচয় নিশ্চিত করা।
২. সকল মৎস্য শ্রমিককে শ্রম আইনের আওতায় আনা।
৩. শ্রমিক ও তাদের পরিবারের সুরক্ষায় সামাজিক নিরাপত্তা স্কিম ও ক্ষতিপূরণ ব্যবস্থা চালু করা।
৪. নিম্নতম মজুরি নির্ধারণ ও ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের সুযোগ সৃষ্টি করা।
৫. পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো।

বিলস উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও জাতীয় মৎস্য শ্রমিক অধিকার ফোরামের আহ্বায়ক নইমুল আহসান জুয়েলের সভাপতিত্বে সংলাপে আলোচনায় অংশ নেন বিলসের নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদ, সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের (এসএসএফ) সভাপতি রাজেকুজ্জামান রতন, বিলস নির্বাহী পরিষদের সম্পাদক শাকিল আক্তার চৌধুরী এবং সলিডারিটি সেন্টার বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর এ কে এম নাসিম।

এছাড়া সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে শ্রম অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক শাহ আব্দুল তারিক, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের আইন কর্মকর্তা মো. নাজমুল ইসলাম এবং মৎস্য অধিদপ্তরের পরিচালক ড. মো. মোতালেব হোসেনসহ জাতীয় মৎস্য শ্রমিক অধিকার ফোরামের সদস্যরা তাদের মতামত তুলে ধরেন।

সংলাপের মূল লক্ষ্য ছিল মৎস্যজীবীদের অধিকার রক্ষায় নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা এবং প্রয়োজনীয় নীতিগত সংস্কারের পক্ষে জনমত গড়ে তোলা।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button