
নিজস্ব প্রতিবেদক: গণপূর্ত অধিদফতরের সাভার সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোহাম্মদ বদরুল আলম খানকে কেন্দ্র করে গণপূর্ত বিভাগের ভেতরে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের আগে তিনি আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাদের ঘনিষ্ঠ পরিচিত ছিলেন। রাজনৈতিক ক্ষমতা পরিবর্তনের পর নিজেকে সচিবের লোক হিসেবে পরিচয় দিয়ে তিনি গণপূর্ত বিভাগের হর্তা-হুমড়ি করার অভিযোগে জড়িত হয়েছেন। মোহাম্মদ বদরুল আলম খানের রাজনৈতিক পরিচিতি গড়ে উঠেছিলো আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ এবং সাবেক গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী মুক্তাদির চৌধুরীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার মাধ্যমে। এসব পরিচয়ের সুবাদে তিনি গণপূর্ত বিভাগের ভেতরে নিজের প্রভাব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। রাজনৈতিক ক্ষমতা পরিবর্তনের পরও বদরুল আলম গণপূর্তের প্রধান নির্বাহী প্রকৌশলীর লোক পরিচয় দিয়ে নিজেদের ক্ষমতার জায়গা বজায় রাখেন। অভিযোগ আছে, তিনি দেশে নির্বাহী প্রকৌশলীদের ফোনে হুমকি ও চাপ প্রয়োগ করে তার মনোনীত ঠিকাদারদের বিভিন্ন প্রকল্পে কাজ নিশ্চিত করান। অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, বদরুল আলম একটি সুসংগঠিত সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। ঠিকাদার “আসিফ” এর মাধ্যমে তিনি প্রভাব বিস্তার করছেন। আসিফ ইতিমধ্যেই পুলিশের বিভিন্ন থানার ভবন ও অন্যান্য সরকারি প্রকল্পে কাজ পেয়েছেন। ঠিকাদাররা জানান, বদরুল আলম ও আসিফের মধ্যে ব্যবসায়িক সম্পর্ক রয়েছে। বদরুল আলম ফোনে বিভিন্ন নির্বাহী প্রকৌশলীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন এবং তাদেরকে চাপ দেন আসিফকে কাজ দিতে। মিরপুর পাইকপাড়া আবাসিক ভবন নির্মাণ প্রকল্পের আরবরিকালচার কাজ নিয়েও অভিযোগ আছে। আরবরিকালচার বিভাগের দায়িত্ব থাকা সত্ত্বেও, বদরুল আলম মিরপুর বিভাগের মাধ্যমে টেন্ডার করান। এছাড়াও, পুলিশের ১০৭ থানা নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় মিরপুর গণপূর্ত বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন ভাষানটেক থানার কাজের টেন্ডারও তার নিয়ন্ত্রণে। এ ছাড়াও, তিনি মাস্তান ভাড়া করে অফিস ঘেরাও করার পরিকল্পনা করেন। যাদের পোস্টিং তার পছন্দমত হয়নি, তাদের একত্রিত করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেন। ডিপ্লোমা প্রকৌশলী সমিতি ও কর্মচারী ইউনিয়নকে সিন্ডিকেটের কাজে সম্পৃক্ত করার জন্য মোটা অঙ্কের টাকার প্রস্তাব দেওয়া হয়। অভিযোগ করা হচ্ছে, এসব কর্মকাণ্ডের কারণে বদরুল আলম নিয়মিত অফিসে উপস্থিত থাকেন না এবং সাইট পরিদর্শনও করেন না। তিনি প্রতিদিন তিনজন প্রধান প্রকৌশলীর সঙ্গে ভিন্ন সময়ে সাক্ষাৎ করেন, যা সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়বে। বদরুল আলম খানের নিজ জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়া হলেও জন্ম, বেড়ে ওঠা, শিক্ষা, কৈশর ও যৌবনকাল ঢাকার খিলগাঁও এলাকায় কেটেছে। খিলগাঁওয়ে বিএনপি নেতাদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বুয়েটে পড়াকালীন সময়ে তিনি ছাত্রদলের কোনো পদে না থাকলেও সকলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখতেন। চাকরি জীবনের শুরু থেকেই তিনি ভাইয়ের সঙ্গে ডেভেলপার ব্যবসা চালু করেন। ভোলায় নির্বাহী প্রকৌশলী থাকাকালীন তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তোলেন। চট্টগ্রাম গণপূর্ত সার্কেল-১-এর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাসিন্দা হিসেবে পরিচয় ব্যবহার করে প্রভাব বিস্তার করেন। বদরুল আলম খানের দাবি অনুযায়ী, ঢাকায় পোস্টিং নিশ্চিত করার জন্য তিনি মন্ত্রীর কাছে তদবির করেন এবং তোফায়েল আহমেদের মাধ্যমেও পদোন্নতির চেষ্টা চালান। এ প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বদরুল আলম রাজনৈতিক পরিচয় পরিবর্তন করে সচিব, জামায়েতে ইসলামী ও অন্যান্য বিভিন্ন পরিচয় দিয়ে নিজের সুবিধা নেন। প্রতিবেদক প্রকৌশলী বদরুল আলমকে কল করলে তিনি সব অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বিষয়টিকে গণপূর্ত অধিদফতরের অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র হিসেবে উল্লেখ করেন, কিন্তু সংশ্লিষ্টদের নাম প্রকাশ করতে অনীহা প্রকাশ করেন। তবে সূত্র বলছে, বদরুল আলম সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ব্যবহার করে ঢাকা পোস্টিং, টেন্ডার এবং নিয়োগের ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট পরিচালনা করছেন। এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে তিনি বিভাগীয় ক্ষমতা কুপ্রয়োগ করছেন, যা গণপূর্ত বিভাগের শৃঙ্খলা ও প্রকল্পের স্বচ্ছতার জন্য হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে। ঠিকাদার ও কর্মচারীরা অভিযোগ করেছেন যে, বদরুল আলম তাদের উপর হুমকি, চাপ এবং ভয় দেখিয়ে কাজ করান। কোন প্রকল্পে আসিফকে কাজ দিতে হবে তা পরিকল্পনা অনুযায়ী সব নির্বাহী প্রকৌশলীকে জানানো হয়। তার নির্দেশনা না মানলে কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। বদরুল আলম সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অফিসের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন। ঠিকাদারদের টেন্ডার দেওয়ার ক্ষেত্রে অংশীদারিত্ব ও লেনদেনের মাধ্যমে তার আর্থিক স্বার্থ নিশ্চিত হচ্ছে। গণপূর্ত বিভাগের কিছু কর্মকর্তা অভিযোগ করেছেন যে, বদরুল আলমের কর্মকাণ্ড প্রশাসনিক শৃঙ্খলা ও নিয়ম-নীতির জন্য বিপজ্জনক। তিনি নিয়মিত অফিসে না আসার কারণে প্রকল্পের সাইট পরিদর্শন ও কর্মসম্পাদনের মান নিয়ন্ত্রণে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। অভিযোগ অনুযায়ী, সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বদরুল আলম বর্তমান প্রধান প্রকৌশলীকে ডিসেম্বরের আগেই চাকরি থেকে বিদায় করার জন্য পরিকল্পনা করছে। অফিসে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ও মাস্তান ভাড়া করে হুমকি প্রদানের মতো ঘটনা তার নিয়ন্ত্রণের অংশ। এই ঘটনা দেখাচ্ছে যে, গণপূর্ত অধিদফতরে রাজনৈতিক প্রভাব, ব্যক্তিগত স্বার্থ এবং ক্ষমতার অপব্যবহার একত্রে মিলিত হয়ে প্রশাসনিক দুর্নীতি ও অনিয়মকে প্রসারিত করছে। বদরুল আলমের কর্মকাণ্ড শুধু নিজের স্বার্থসিদ্ধি নয়, বরং পুরো বিভাগীয় পরিবেশকে অস্থিতিশীল করছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এমন সিন্ডিকেট প্রশাসনিক স্বচ্ছতার জন্য মারাত্মক হুমকি। প্রকল্পের সঠিক বাস্তবায়ন, সময়মতো নির্মাণ কাজ ও সরকারি অর্থের সুষ্ঠু ব্যবহার বিপন্ন হচ্ছে। মোহাম্মদ বদরুল আলম খানের বিরুদ্ধে দায়ের অভিযোগগুলো গণপূর্ত বিভাগের শৃঙ্খলা, প্রকল্পের স্বচ্ছতা এবং কর্মচারী নিরাপত্তার জন্য গুরুতর হুমকি স্বরূপ। রাজনৈতিক পরিচয় ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে তিনি নিজস্ব সুবিধা নিশ্চিত করতে সচেষ্ট। অভিযোগ সূত্রে দেখা যাচ্ছে, সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ঠিকাদার নিয়োগ, টেন্ডার ও পোস্টিং নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বদরুল আলম। এখন প্রশ্ন হচ্ছে—সরকারি পর্যায়ের দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ কি এই সিন্ডিকেট ও অনিয়মের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেবে, নাকি এটি একইভাবে অব্যাহত থাকবে। এই ঘটনার পটভূমি, প্রভাব ও সম্ভাব্য প্রশাসনিক পরিণতি ভবিষ্যতে গণপূর্ত বিভাগের কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে।



