ইয়াবা আত্মসাত, অনিয়ম ও বিতর্কিত অভিযানের পর সদর দপ্তরের সিদ্ধান্ত
নিজস্ব প্রতিবেদক: কক্সবাজার ও বান্দরবান নিয়ে গঠিত র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন–১৫ (র্যাব–১৫)-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল কামরুল হাসানসহ তিন শতাধিক সদস্যকে একযোগে বদলি করা হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে ইয়াবা উদ্ধারসংক্রান্ত অসঙ্গতি, মামলার কাগজে কম দেখানো, আর্থিক অনিয়ম এবং বেশ কয়েকটি বিতর্কিত অভিযানকে কেন্দ্র করে সদর দপ্তরের অভ্যন্তরীণ তদন্ত শুরু হয়। সেই তদন্তে গুরুতর অসামঞ্জস্য ধরা পড়ার পরই এ গণবদলি করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে। তবে র্যাবের মিডিয়া উইং বলছে—এটি নিয়মিত বদলি প্রক্রিয়ার অংশ।
র্যাব সদর দপ্তরের নথি অনুযায়ী, গত ১৯ নভেম্বর এক প্রজ্ঞাপনে ১৯৮ সদস্য এবং একই তারিখে আরেক প্রজ্ঞাপনে আরও ২০০ সদস্যকে বদলি করা হয়। পরে ২৭ নভেম্বর জারি হওয়া তৃতীয় দফার প্রজ্ঞাপনে আরও ৭৪ সদস্যকে সরিয়ে নেওয়া হয়। তিন দফা আদেশ বিশ্লেষণে দেখা গেছে—বদলি হওয়া তিন শতাধিক সদস্যের বড় অংশই র্যাব–১৫ এ কর্মরত ছিলেন। একই ইউনিট থেকে এত বিপুল সংখ্যক সদস্যের বদলি সাম্প্রতিক সময়ে প্রায় নজিরবিহীন।
এক বছর র্যাব–১৫ এর অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর লেফটেন্যান্ট কর্নেল কামরুল হাসানকে র্যাব সদর দপ্তরে সংযুক্ত করা হয়েছে। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ নেয়ামুল হালিম খান পিএসসি—করোনাকালে যশোর সেনানিবাসের ৫৫ পদাতিক ডিভিশনের ৩৭ বীর ইউনিটে যিনি দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
র্যাবের মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক উইং কমান্ডার এম জেড এম ইন্তেকাব চৌধুরী বলেন,এত সদস্যকে বদলি করা নিয়মিত রোটেশন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই দেখা উচিত। কেউ অপরাধে জড়িত থাকলে র্যাব তদন্তের মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে।
অন্যদিকে র্যাব সংশ্লিষ্ট একাধিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানিয়েছেন—বদলি নিয়মিত হলেও এর পেছনে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে র্যাব–১৫’কে ঘিরে ওঠা একাধিক গুরুতর অভিযোগই বড় কারণ হিসেবে কাজ করেছে। সদর দপ্তরে গঠিত বিশেষ টিমের অনুসন্ধানে দুটি আলোচিত অভিযানে গুরুতর “তথ্যগত ও প্রক্রিয়াগত অসঙ্গতি” ধরা পড়ে।
কুতুপালংয়ের অভিযানে ইয়াবা আত্মসাতের অভিযোগ
গত ৭ সেপ্টেম্বর উখিয়ার কুতুপালং পশ্চিম পাড়ায় অভিযানে র্যাব–১৫ দুই নারীকে ৮৯ হাজার ৬০০ পিস ইয়াবাসহ আটক দেখায়। উদ্ধার দেখানো হয় ১৬ লাখ ৭১ হাজার ৮৩০ টাকা। তদন্তসূত্রের দাবি—সেখানে প্রকৃত ইয়াবার পরিমাণ আরও বেশি ছিল এবং প্রায় ১ লাখ ১০ হাজার ইয়াবা আত্মসাত করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া স্থানীয় যুবদল নেতা হেলাল উদ্দিনের সহযোগী সেলিম উদ্দিনের নাম মামলায় যোগ করা হয় “ভুল তথ্যের ভিত্তিতে”।
লেদা অভিযানের অস্বাভাবিক উদ্ধারতালিকা
২৬ সেপ্টেম্বর টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের লেদা এলাকায় আরেক অভিযানে শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত জাহাংগীর আলমকে গ্রেপ্তার করে র্যাব–১৫। কিন্তু জব্দতালিকায় দেখানো হয় ৭টি ইটের টুকরা ও ২টি কাঠের লাঠি—যা স্থানীয় জনগণের মধ্যে ব্যাপক প্রশ্নের জন্ম দেয়। ঘটনাটি সামাজিকমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে।
উভয় অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন তৎকালীন র্যাব–১৫ অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল কামরুল হাসান। তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র দাবি করছে—এসব অভিযানের নেপথ্যে প্রভাবশালী ভূমিকা রেখেছেন টেকনাফ এফএস কমান্ডার কর্পোরাল ইমাম, যিনি তাঁদের ঘনিষ্ঠজন ও অভিযানের সমন্বয়কারী ছিলেন।
তদন্ত চলমান, আইনি ব্যবস্থার ইঙ্গিত
ইয়াবা আত্মসাত, আর্থিক লেনদেনের অসঙ্গতি, তথ্য বিভ্রাট—সব অভিযোগই এখন সদর দপ্তরের নজরদারিতে রয়েছে। র্যাব মিডিয়া উইং জানাচ্ছে—“তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কারও বিরুদ্ধে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেয়া যাবে না। তবে দোষী প্রমাণিত হলে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।”
কক্সবাজার-টেকনাফ অঞ্চলে মাদকবিরোধী অভিযান বরাবরই র্যাবের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। এই দায়িত্বপালনে এত বড় পরিসরে বদলি—বিশেষজ্ঞদের মতে—সংস্থার ভেতরেও এক ধরনের কাঠামোগত পুনর্বিন্যাসের ইঙ্গিত দিচ্ছে।



