
হবিগঞ্জ প্রতিনিধি: হবিগঞ্জ জেলা কারাগারের প্রধান ফটকে বড় বড় অক্ষরে লেখা—‘রাখিব নিরাপদ, দেখাব আলোর পথ’। কিন্তু কারাগারের ভেতরে বন্দিদের বাস্তবতা এই স্লোগানের ঠিক উল্টো। নিরাপদ আশ্রয় আর সংশোধনের বদলে সেখানে চলছে অনিয়ম ও দুর্নীতির এক অঘোষিত রাজত্ব। খাবারের নিম্নমান থেকে শুরু করে সিট বাণিজ্য—টাকা ছাড়া যেন কিছুই নড়ে না এই কারাগারে। কারামুক্ত একাধিক ব্যক্তি ও ভুক্তভোগী পরিবারের বর্ণনায় উঠে এসেছে এই ভয়াবহ চিত্র।
অভিযোগ রয়েছে, সরকারিভাবে বন্দিদের জন্য পর্যাপ্ত খাবারের বরাদ্দ থাকলেও তা ঠিকমতো পাতে পৌঁছায় না। রেশনের টাকা বা উপকরণে নয়ছয় করে বন্দিদের দেওয়া হয় অত্যন্ত নিম্নমানের খাবার, যা অনেক সময় খাওয়ার অযোগ্য হয়ে পড়ে। কারাগারের ভেতরেও অর্থের দাপট স্পষ্ট। যারা টাকা দিতে পারেন, কেবল তাদের ভাগ্যেই জোটে ভালো খাবার। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সদ্য কারামুক্ত এক ব্যক্তি জানান, “ভেতরের খাবার মুখে তোলার মতো না। কিন্তু প্রতিবাদ করার সাহস কারও নেই। অভিযোগ করলেই নেমে আসে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন। তাই সবাই মুখ বুজে সহ্য করেন।”
কারাগারের অন্যতম বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘সিট বাণিজ্য’। নতুন কোনো বন্দি কারাগারে ঢুকলেই সক্রিয় হয়ে ওঠে ফাইল পাহারাদারদের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। ভালো ওয়ার্ডে বা সুবিধাজনক জায়গায় সিট দেওয়ার কথা বলে নতুন বন্দিদের কাছে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করা হয়। ভুক্তভোগীদের মতে, এখানে টাকাই শেষ কথা। টাকা থাকলে কারাগারেও কিছুটা আরামে থাকা যায়, আর না থাকলে পোহাতে হয় অমানবিক কষ্ট।
বন্দিদের জিম্মি করে তাদের পরিবারের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের অভিযোগও দীর্ঘদিনের। স্বজনরা অভিযোগ করেন, কারাগারে থাকা প্রিয়জনেরা যাতে ভালো থাকেন, সে জন্য তারা নিয়মিত টাকা পাঠাতে বাধ্য হন। টাকা না পাঠালে ভেতরে বন্দিদের ওপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করা হয়।
এছাড়া, সাক্ষাৎপ্রার্থীদের কাছ থেকে বন্দিদের খরচের জন্য দেওয়া টাকার একটি অংশ (শতকরা ২০ টাকা হারে) কতিপয় অসাধু কারারক্ষী কেটে রাখেন বলে অভিযোগ রয়েছে। জেল কোড অনুযায়ী, সপ্তাহে একদিন মোবাইল ফোনে কথা বলা এবং ১৫ দিন পর পর স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাতের নিয়ম রয়েছে। কিন্তু হবিগঞ্জ কারাগারে টাকার বিনিময়ে এসব নিয়ম ইচ্ছেমতো শিথিল করা যায়। উৎকোচ দিলে নির্ধারিত সময়ের বাইরেও কথা বলা বা দেখা করার সুযোগ মেলে।
কারাগারকে ঘিরে এমন গুরুতর সব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে হবিগঞ্জ জেলা কারাগারের জেল সুপার সব অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, “কারাগারে অনিয়মের অভিযোগ সত্য নয়। তবে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো কারারক্ষীর বিরুদ্ধে অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
সচেতন মহলের মতে, কারাগার সংশোধনাগার হওয়ার কথা থাকলেও হবিগঞ্জ কারাগার বর্তমানে বাণিজ্যের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে এবং বন্দিদের মানবিক অধিকার রক্ষায় এখানে দ্রুত তদন্ত ও সংস্কার প্রয়োজন।



