ইতিহাস ও ঐতিহ্যজাতীয়দেশপ্রশাসনফিচারডবাংলাদেশ

আখাউড়া যুদ্ধ: মুক্তিযুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া এক ঐতিহাসিক লড়াই

ফিচার ডেস্ক: একাত্তরের রণাঙ্গনে পূর্বাঞ্চলীয় সেক্টরের বিজয়ের ইতিহাসে ‘আখাউড়া যুদ্ধ’ এক অনন্য অধ্যায়। ১৯৭১ সালের ৩০ নভেম্বর থেকে ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলা এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধই মূলত ওই অঞ্চলের যুদ্ধের গতিপথ নির্ধারণ করে দিয়েছিল। ঢাকা-চট্টগ্রাম ও সিলেটের রেল যোগাযোগের কেন্দ্রবিন্দু এবং ভারত সীমান্ত থেকে মাত্র ৩-৪ কিলোমিটার দূরত্বের কারণে আখাউড়া ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে অত্যন্ত কৌশলগত ও মর্যাদাপূর্ণ ঘাঁটি।

দিঘি, উঁচু বাঁধ, রেললাইন এবং পাকা স্থাপনাগুলোকে কাজে লাগিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী আখাউড়ায় গড়ে তুলেছিল এক দুর্ভেদ্য প্রতিরক্ষা বলয়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল যে কোনো মূল্যে পূর্বাঞ্চলীয় নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা। কিন্তু সেই দুর্ভেদ্য দুর্গ তছনছ হয়ে যায় মুক্তিপাগল বাঙালি ও মিত্রবাহিনীর সম্মিলিত রণকৌশলের কাছে।

৩০ নভেম্বর—যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। মুক্তিবাহিনীর ‘এস ফোর্স’ এবং মিত্রবাহিনীর সমন্বিত দল নোয়াপাড়া ও লোনাসার এলাকায় প্রথম আঘাত হানে। শত্রুপক্ষ পাল্টা প্রতিরোধ গড়লেও দিনব্যাপী তুমুল লড়াইয়ের পর তাদের প্রথম প্রতিরক্ষা রেখা ভেঙে পড়ে।

১ ও ২ ডিসেম্বর—লড়াইয়ের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে আখাউড়া রেলস্টেশন। পাকিস্তানি বাহিনীর মূল প্রতিরক্ষা ছিল এই স্টেশন ঘিরে। মুক্তিবাহিনী গঙ্গাসাগরের বাঁধ ও রেললাইনের পাশ দিয়ে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে শত্রুর দ্বিতীয় স্তরের প্রতিরক্ষায় ফাটল ধরানো শুরু করে। এই দুই রাতে পাকিস্তানিরা বারবার পাল্টা আক্রমণ চালিয়েও সুবিধা করতে পারেনি। উল্টো যৌথ বাহিনী রেলস্টেশনের দক্ষিণ দিকে নিজেদের অবস্থান শক্ত করে নেয়।

৩ ডিসেম্বর সকালে মিত্রবাহিনী গঙ্গাসাগর রেলস্টেশন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নেয়। এটি ছিল পাকিস্তান বাহিনীর জন্য বড় ধাক্কা। ওই দিন বিকেলে তারা মরিয়া হয়ে পাল্টা হামলা চালালেও যৌথ বাহিনীর গোলন্দাজ ইউনিটের ভারী বর্ষণে পিছু হটতে বাধ্য হয়। ৪ ডিসেম্বর শুরু হয় সর্বাত্মক আক্রমণের প্রস্তুতি। মিত্রবাহিনীর মিডিয়াম ব্যাটারি, মর্টার, রকেট লঞ্চার এবং পদাতিক বাহিনীর ত্রিমুখী হামলায় আখাউড়ার দক্ষিণ ও পশ্চিম অংশের পাকিস্তানি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।

৫ ডিসেম্বর রাত—চারদিকে তখন বারুদের গন্ধ। ঠিক এই রাতেই শুরু হয় যৌথ বাহিনীর চূড়ান্ত ও সর্বাত্মক অভিযান। উত্তর, পশ্চিম ও দক্ষিণ দিক থেকে একযোগে চালানো এই সাঁড়াশি আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়ে। অবশেষে সকাল ৮টার মধ্যে আখাউড়ার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেয় যৌথ বাহিনী।

এই বিজয় কেবল একটি জনপদ মুক্ত করা ছিল না; এটি ব্রাহ্মণবাড়িয়া, আশুগঞ্জ ও মন্দভাগ অভিমুখে মিত্রবাহিনীর অগ্রযাত্রাকে ত্বরান্বিত করে। আখাউড়া যুদ্ধ প্রমাণ করে যে, আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনীর চেয়ে বাঙালির মুক্তির আকাঙ্ক্ষা, মনোবল এবং সঠিক রণকৌশল ছিল অনেক বেশি শক্তিশালী।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button