দোহাজারীতে ফিল্মি স্টাইলে বসতবাড়িতে হামলা, নগদ অর্থ–স্বর্ণালংকার লুটপাট

মুহাম্মদ জুবাইর:
জায়গা-সম্পত্তির বিরোধে আতঙ্কে সাধারণ মানুষ
চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার দোহাজারী পৌরসভা দীর্ঘদিন ধরেই জমি-জমার দ্বন্দ্ব, পারিবারিক বিরোধ, ও ক্ষমতাধর মহলের দাপট নিয়ে আলোচনায় রয়েছে। তবে এবার খানবাড়ী এলাকায় সংঘটিত একটি ভয়াবহ হামলার ঘটনা পুরো এলাকাজুড়ে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। সোমবার (১ ডিসেম্বর) সকালে প্রায় ৫০–৬০ জনের সশস্ত্র, মুখোশধারী বহিরাগত সন্ত্রাসী ফিল্মি স্টাইলে একাধিক বসতবাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর, লুটপাট এবং মারধর করে বলে অভিযোগ উঠেছে।এই ঘটনা শুধু ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারই নয়, পুরো দোহাজারী এলাকার মানুষকে আতঙ্কিত করে তুলেছে। দিনদুপুরে এমন ভয়ংকর সশস্ত্র তাণ্ডব—এলাকার নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা নিয়ে বড় প্রশ্ন তুলে দিয়েছে।
হামলার টার্গেট—বহুদিনের জমি বিরোধকে কেন্দ্র করে বাড়ি নির্মাণ,স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী দোহাজারী পৌরসভার আমীর মাওলানা এম. জমির আদনান খানবাড়ী এলাকায় তার নিজস্ব বসতভিটায় একটি পাকা ঘর নির্মাণ করছিলেন। নির্মাণকাজ স্বাভাবিকভাবে এগোচ্ছিল। তবে দীর্ঘদিনের বিরোধে থাকা প্রতিপক্ষ পক্ষ এ নির্মাণকে কেন্দ্র করে ক্ষুব্ধ ছিল,ভুক্তভোগীদের দাবি, প্রতিপক্ষ অনেকদিন ধরেই হুমকি দিয়ে আসছিল—ঘর তুলতে দিলে ভালো হবে না।কিন্তু কেউই ধারণা করতে পারেননি যে প্রতিপক্ষ এত বড় সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে সরাসরি হামলা চালাবে।
সোমবার সকাল: দোহাজারীতে ‘সশস্ত্র সিনেমার দৃশ্য,ঘড়ির কাঁটা তখন সকাল ৭টা–৭টা ১০ মিনিটের মধ্যে। এলাকার অধিকাংশ মানুষ নাশতা বা সকালবেলার কাজ নিয়ে ব্যস্ত। ঠিক এই সময়টিতেই প্রায় ৫০–৬০ জন বহিরাগত সন্ত্রাসী এলাকা ঘিরে ফেলে।
তারা—মুখে কালো কাপড়,হাতে লোহার রড, দা, ফলা
কিছুজনের হাতে গ্রাইন্ডার মেশিন,কেউ কেউ পকেটে ইটপাটকেল নিয়ে আসে,সরাসরি লক্ষ্য—এম. জমির আদনানের নির্মাণাধীন পাকা ঘর এবং তার পাশের আরও দুইটি পারিবারিক বসতঘর।প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান—
একটা দল সামনে দাঁড়িয়ে ঢিল ছুঁড়ছিল, আরেক দল দ্রুত ঘরে ঢুকে ভাঙচুর শুরু করে। এমন দৃশ্য আমরা সিনেমাতেই দেখি।গ্রাইন্ডার মেশিন দিয়ে লোহার রড কেটে ফেলা—পরিকল্পিত তাণ্ডব,নির্মাণাধীন ঘরে তখন লোহার রড বসানোর কাজ চলছিল। হামলাকারীরা কোনো কিছুতেই সময় নষ্ট করেনি। সরাসরি গিয়ে—ঘরের কলাম কেটে ফেলে,রড ভেঙে দেয়,দোতলা নির্মাণের কাঠামো নষ্ট করে,ঘরের ভেতরে থাকা সিমেন্টের বস্তা, ইট ও কাজের সরঞ্জাম ধ্বংস করে,সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল গ্রাইন্ডার ব্যবহার।এটি সাধারণত পেশাদার নির্মাণকর্মীরা ব্যবহার করেন। কিন্তু সন্ত্রাসীরা এই গ্রাইন্ডার দিয়ে কলামের লোহা কেটে পুরো কাঠামো অকার্যকর করে দেয়।স্থানীয়রা বলেন—এভাবে তো কেউ হঠাৎ হামলা করতে আসে না। পুরো ঘটনা দেখেই মনে হয় পরিকল্পনা করে, প্রস্তুতি নিয়ে, লোক ভাড়া করে তারা এসেছে।বাঁধা দিতে গেলে নারীদের ওপর বর্বর হামলা,
হামলার শব্দ শুনে ঘর থেকে বের হয়ে প্রতিরোধ করতে গেলে হামলাকারীরা আরও ভয়ংকর হয়ে ওঠে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ অনুযায়ী, সন্ত্রাসীরা—সাবেক কাউন্সিলর আয়শা আক্তার,পারভীন আক্তার,হাফসা বেগম,মিজবাহএই চারজনকে মারধর করে গুরুতর আহত করে। তাদের মাথা, কাঁধ ও হাতে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। স্থানীয়রা তাদের দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন।
একজন আহত নারী কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন—আমরা শুধু বলেছিলাম—ভাঙচুর করবেন না। এটাই আমাদের অপরাধ? ওরা আমাদের উপর এমনভাবে হামলা করে যেন আমরা শত্রু!সন্ত্রাসীরা শুধু মারধর করেই থেমে যায়নি, বরং নারীদের গালিগালাজ করে বাড়ির ভেতরে ঢুকে লুটপাট শুরু করে।ঘরের আলমারি ভেঙে নগদ টাকা–স্বর্ণ লুট,ভুক্তভোগী পরিবার জানায় নির্মাণকাজের জন্য রাখা নগদ টাকা,নারীদের ব্যবহারের স্বর্ণালংকার
ঘরের দামী আসবাবপত্র,ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী
সবকিছু লুট করে নিয়ে যায়।বাড়িগুলোতে থাকা আলমারি ও ট্রাঙ্ক গ্রিল কাটার মেশিন দিয়ে ভেঙে ফেলে।লুট হওয়া স্বর্ণালংকারের মূল্য অনেক, কিন্তু নিরাপত্তাজনিত কারণে পরিবারটি এখনও পরিমাণ প্রকাশ করছে না।একজন পরিবারের সদস্য বলেন—ঘরের যা ছিল সবই লুট করে নিয়েছে। নির্মাণের জন্য জমিয়ে রাখা টাকা পর্যন্ত নিয়ে গেছে। আমাদের কিছুই রাখেনি।আতঙ্কে নিস্তব্ধ খানবাড়ী এলাকা,হামলার সময় এলাকার মানুষ ভয় ও আতঙ্কে ঘর থেকে বের হতে পারেনি।কারণ—হামলাকারীরা সশস্ত্র,তাদের সংখ্যা অনেক,মুখ ঢেকে রেখেছিল
শব্দ করলেই আক্রমণ করতে পারে,ফলে পুরো খানবাড়ী এলাকা প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে সন্ত্রাসীদের দখলে ছিল,একজন স্থানীয় দোকানদার বলেন—আমরা দূর থেকে দেখলাম—ওরা সংগঠিতভাবে ঘর ভাঙছে। কিন্তু একজনও এগোতে সাহস পাইনি। পুলিশের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় ছিল না।হামলাকারীরা কারা? স্থানীয় না বহিরাগত?ভুক্তভোগীদের দাবি—
এদের বেশিরভাগই এলাকা-বহিরাগত।প্রতিপক্ষ জমি দখল করতে লোক ভাড়া করেছে।কিছু প্রত্যক্ষদর্শী দাবি করেছেন—হামলাকারীদের কয়েকজন স্থানীয় হলেও বড় অংশ এসেছে বাইরে থেকে, সম্ভবত ভাড়া করা সন্ত্রাসী,সমগ্র ঘটনা দেখে মনে হয়েছে এটি,পূর্বপরিকল্পিত
সংগঠিতঅর্থায়িতপেশাদার সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করা
এগুলো ইঙ্গিত করে যে বিরোধ শুধু ‘জায়গা’ নয়, বরং ‘ক্ষমতা ও দাপট’ প্রদর্শনের সক্ষমতা।ভুক্তভোগী পরিবারের অভিযোগ: এটি শুধু বিরোধ নয়, হত্যাচেষ্টা সমতুল্য হামলা,ভুক্তভোগী পরিবার চন্দনাইশ থানায় লিখিত অভিযোগ করেছে। তারা অভিযোগে বলেছেন—
ভাঙচুরলুটপাটনারীদের ওপর হামলাঅস্ত্র নিয়ে বাড়িতে অনুপ্রবেশসম্পূর্ণ ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমএসব মিলিয়ে হামলাটি শুধু বিরোধ নয়, বরং জীবনের ওপর সরাসরি হুমকি।এম. জমির আদনান বলেন—আমরা দীর্ঘদিন আদালতে লড়াই করছি। কিন্তু প্রতিপক্ষ আইনকে পাত্তা দেয় না। তারা শক্তি দিয়ে আমাদের দমিয়ে দিতে চায়।তিনি আরও বলেন—এভাবে দিনের আলোয় ৫০–৬০ জন লোক নিয়ে যে হামলা চালানো হয়েছে, তা রাষ্ট্রের প্রতি চরম চ্যালেঞ্জ ছাড়া কিছুই নয় ।পুলিশ অভিযোগটি গুরুত্বসহকারে তদন্ত করা হচ্ছে,চন্দনাইশ থানার ওসি জানিয়েছেন—লিখিত অভিযোগ পাওয়া গেছেঘটনাস্থল পরিদর্শন করা হয়েছে,ভাঙচুরের চিহ্ন নিশ্চিত করা হয়েছেহামলায় ব্যবহৃত কিছু ইট ও লোহার অংশ উদ্ধার করা হয়েছেওসি আরও বলেন—এটি গুরুত্বসহকারে তদন্ত করা হচ্ছে। ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তবে স্থানীয়রা বলছেন—এই হামলার পিছনে শক্তিশালী একটি চক্র কাজ করছে। তাই পুলিশকে আরও কঠোর হতে হবে।
স্থানীয়দের দাবি—এটি সন্ত্রাসী শক্তির দাপট, আইনশৃঙ্খলার বড় প্রশ্ন
এলাকার মানুষ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন—দিনদুপুরে ৫০–৬০ জন সশস্ত্র লোক এলাকা দখল করে নিল, কেউ থামাতে পারল না।এটা যদি শহরের ভেতরে হতে পারে, তবে নিরাপত্তা কোথায়?এভাবে হামলা চললে সাধারণ মানুষ কোথায় যাবে?অনেকে দাবি করছেন, এটি সাম্প্রতিক সময়ে দোহাজারী এলাকায় সংঘটিত সবচেয়ে বড় তাণ্ডব।ঘর ভাঙা শুধু ক্ষতি নয়—পরিবারগুলোর ‘মানসিক ধস’ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা এখনও মানসিক আঘাত থেকে বের হতে পারেননি।নিরিহ নারীরা কাঁদছেন, শিশুরা আতঙ্কে।বাড়ির ভাঙা দরজা–জানালা, চূর্ণবিচূর্ণ আসবাবপত্রের দিকে তাকালে মনে হয় যেন—
বাড়ি নয়যুদ্ধক্ষেত্র,একজন আহত নারী বলেন—
এতদিন ধরে আমরা এই বাড়িটাকে শিকড় ধরে রেখেছিলাম। আজ এক ঝাঁকে এসে সব ভেঙে গেল। আমরা কোথায় দাঁড়াব?জমি বিরোধ কি এই ঘটনার মূল কারণ? না কি ক্ষমতার খেলা?স্থানীয়রা বলছেন—বিরোধ বছরের পর বছর চলছে,আদালতেও মামলা আছে,উভয়পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা পুরনো
কিন্তু এভাবে সংগঠিত হামলা আগে হয়নি
বেশিরভাগের ধারণা—এটি পরিকল্পিত ক্ষমতা প্রদর্শন। বিরোধকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষ নিজের শক্তি দেখিয়েছে।ভুক্তভোগী পরিবারের আহ্বান—দ্রুত ন্যায়বিচার ভুক্তভোগী পরিবার বলছে—হামলাকারীদের আইনের আওতায় আনতে হবে।ক্ষয়ক্ষতির সঠিক তদন্ত চাই।আমাদের বাড়ি পুনর্নির্মাণে নিরাপত্তা চাই।
এলাকার মানুষ যাতে শান্তিতে থাকতে পারে, সেই পরিবেশ ফিরিয়ে দিন।তারা আরও বলেন—আমরা আইনের প্রতি বিশ্বাস রাখি। আশা করছি প্রশাসন দ্রুত ব্যবস্থা নেবে।
এই ধরনের হামলা শুধু একটি পরিবারের ক্ষতি নয়; এটি সমাজের নিরাপত্তার ওপর আঘাত,দোহাজারীর এই ঘটনা দেখিয়ে দিয়েছে—সন্ত্রাসীরা সংগঠিত হলে কোনো এলাকা নিরাপদ থাকে না,আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্রুত পদক্ষেপ জরুরিজমি-বিরোধকে কেন্দ্র করে সহিংসতার প্রবণতা বাড়ছে
বহিরাগত সন্ত্রাসী ব্যবহার এখন নতুন ট্রেন্ড,দিনের আলোতেও সন্ত্রাসীরা ভয় পায় না,এই ঘটনা শুধু দোহাজারীর নয়, চট্টগ্রামের, এমনকি দেশের মানুষের মধ্যেও প্রশ্ন তুলেছে—আইনের শাসন কোথায়? সাধারণ মানুষ কতটা নিরাপদ?



