দিল্লির শাসনমুক্ত স্বতন্ত্র রাষ্ট্রসত্তা: বাংলাদেশ ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের পুনর্পাঠ

সংগৃহীত সংবাদ (আহমেদ মুসাফা): ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও ইতিহাসের নিরিখে বিচার করলে দেখা যায়, বাংলাদেশ কোনো ‘ছদ্ম পাকিস্তান’ নয়; বরং ১৯৪০-এর দশকে দিল্লি বা কলকাতার শাসনমুক্ত যে স্বতন্ত্র রাষ্ট্রব্যবস্থার স্বপ্ন দেখা হয়েছিল, বাংলাদেশ হলো তার প্রকৃত রূপ। এই ভূখণ্ডটি মূলত দিল্লির শাসনকাঠামো থেকে আলাদা একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রকল্পেরই নামান্তর।
ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায়, এই উপমহাদেশের মুসলমানদের রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের প্রধান মঞ্চ ‘মুসলিম লীগ’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ঢাকার শাহবাগে। এই দলই পরবর্তীতে পাকিস্তান আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়। তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী ছিল কলকাতা। কিন্তু কলকাতার শাসকগোষ্ঠী বা অভিজাত সমাজ পূর্ব বাংলার উন্নয়ন কখনোই চায়নি। এমনকি ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও তাদের প্রবল বিরোধিতা ছিল। এই বঞ্চনা থেকেই এখানকার মানুষ সর্বপ্রথম অনুধাবন করতে পেরেছিল যে, নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় একটি স্বাধীন ও স্বতন্ত্র ভূখণ্ড অপরিহার্য।
এরই ধারাবাহিকতায় উত্থাপিত হয় ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে একমাত্র বাংলাতেই মুসলিম লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। ঐতিহাসিক সত্য হলো—বাংলার মানুষের সমর্থন এবং এখান থেকে উঠে আসা আইডিয়া বা ধারণা না থাকলে ‘পাকিস্তান’ নামক কোনো রাষ্ট্রের জন্মই হতো না। এমনকি উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে ‘পশ্চিম পাকিস্তান’ বলেও কিছুর অস্তিত্ব থাকত না।
বাংলার ইতিহাসের আরও গভীরে তাকালে দেখা যায়, গত এক হাজার বছরের বেশিরভাগ সময়ই এই জনপদ স্বাধীন ছিল। এখানে ছিল স্বাধীন ‘বাঙ্গালাহ সালতানাত’। মোগল আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন বারো ভূঁইয়ারা। বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা দাপটের সঙ্গে শাসন করেছেন স্বাধীন নওয়াবরা। অর্থাৎ, দিল্লির অধীনতা অস্বীকার করে স্বতন্ত্রভাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোই আমাদের পূর্বপুরুষদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য।
বর্তমানে একটি বিশেষ গোষ্ঠী সুকৌশলে আমাদের এই ইতিহাসকে বিকৃত বা মুছে ফেলার চেষ্টা করছে। তারা আমাদের পূর্বপুরুষদের পাকিস্তান সৃষ্টির প্রেক্ষাপট এবং দিল্লির শাসনমুক্ত থাকার আকাঙ্ক্ষাকে আড়াল করতে চায়। মূলত ‘অখণ্ড ভারত’-এর ন্যারেটিভ বা বয়ান প্রতিষ্ঠা করাই তাদের লক্ষ্য।
বাস্তবতা হলো, এই উপমহাদেশে দিল্লির আধিপত্যের বাইরে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের যে স্বপ্ন একসময় ‘পাকিস্তান’ নামে পরিচিত ছিল, ১৯৭১ সালে তা ‘বাংলাদেশ’ নামে বিশ্বমঞ্চে স্থান করে নিয়েছে। নাম পরিবর্তন হলেও মূল আকাঙ্ক্ষা বা দর্শনের কোনো পরিবর্তন হয়নি। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, ততদিন এই ভূখণ্ডের মানুষের স্বতন্ত্র ও স্বাধীন সত্তার এই আকাঙ্ক্ষাকে মুছে ফেলা সম্ভব হবে না।



