Uncategorizedঅপরাধজাতীয়দুর্নীতিবাংলাদেশবিশেষ প্রতিবেদন

এলজিইডির ‘নতুন জমিদার’ পিডি এনামুল: সরকারি প্রকল্পে ব্যক্তিগত রাজত্ব ও হাজার কোটি টাকার অনিয়ম

নিজস্ব প্রতিবেদক: সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকার সরকারি প্রকল্পকে যেন নিজের ব্যক্তিগত জমিদারিতে পরিণত করেছেন প্রকল্প পরিচালক (পিডি) মো. এনামুল কবির। জলবায়ু সহনীয়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ক্ষুদ্র পানিসম্পদ উন্নয়ন প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে উঠেছে ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি এবং স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ। এলজিইডির নিজস্ব ভবন থাকা সত্ত্বেও রাজধানীর শেওড়াপাড়ায় বিলাসবহুল অফিস ভাড়া নেওয়া, নিয়োগ বাণিজ্য এবং শ্যালককে দিয়ে অফিস নিয়ন্ত্রণ—সবই চলছে তার ইচ্ছামতো।

অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে গত ২৮ অক্টোবর ২০২৫ তারিখে উপসচিব মোহাম্মদ শামীম বেপারী স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে (স্মারক নং-৪৬.০০.০০০০.০৬৮.৯৯.০৭১.২৪-১০৮৭) ৩ দিনের মধ্যে ব্যাখ্যা ও তথ্য তলব করা হয়েছে।

ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার বুযিডাঙ্গা গ্রামের এক সাধারণ ফরিয়া ব্যবসায়ী ইছরাইল হোসেনের ছোট ছেলে এনামুল কবির। পরিবারের আর্থিক অনটনের কারণে একসময় মহাজনের টাকায় পড়াশোনা চলত। কিন্তু চাকরিতে ঢোকার পর থেকেই বদলে যেতে থাকে তার ভাগ্য। অভিযোগ রয়েছে, দুর্নীতির মাধ্যমে তিনি গ্রামের বাড়িতে রাজকীয় ডুপ্লেক্স বাড়ি নির্মাণসহ শত শত বিঘা জমি কিনেছেন। তার জীবনযাপন এখন এতটাই বিলাসী যে, ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িতে যাতায়াত করেন হেলিকপ্টারে। স্থানীয়রা তাকে এখন ডাকেন ‘নতুন জমিদার’ বলে।

সিলেটে নির্বাহী প্রকৌশলী এবং পরবর্তীতে এলজিইডির সাবেক প্রধান প্রকৌশলী ওয়াহিদুর রহমানের স্টাফ অফিসার থাকাকালে এনামুলের বিরুদ্ধে ভুয়া বিল ও আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছিল। বর্তমান প্রকল্পে যোগদানের পর সেই অনিয়মের মাত্রা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে।

এলজিইডির নিজস্ব বিশাল ভবন থাকা সত্ত্বেও এনামুল কবির রাজধানীর শেওড়াপাড়ার আগোরা ভবনে সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনে বাণিজ্যিক হারে তিনগুণ ভাড়ায় নতুন অফিস নিয়েছেন। মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়াই তিনি প্রায় দুই কোটি টাকা ব্যয়ে অফিসটি রাজকীয় ঢঙে সাজিয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, এই সাজসজ্জার নামে ভুয়া বিল-ভাউচারের মাধ্যমে লোপাট হয়েছে বিপুল অর্থ।

অফিসটি কার্যত নিয়ন্ত্রণ করেন এনামুলের শ্যালক ফরিদ। কোনো সরকারি পদে না থেকেও ফরিদ অফিসের কেনাকাটা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে আছেন। তার জন্য রয়েছে আলাদা কক্ষ, যেখানে সন্ধ্যার পর বহিরাগতদের নিয়ে আড্ডা চলে বলে অভিযোগ রয়েছে।

প্রকল্পে আউটসোর্সিং ও কনসালট্যান্ট পদে প্রায় ৫০০ কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে বড় ধরনের বাণিজ্যের অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রতিটি পদের জন্য ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা ঘুষ নেওয়ার পাশাপাশি নিয়োগ পাওয়াদের মধ্যে অর্ধশতাধিক ব্যক্তি এনামুলের আত্মীয়-স্বজন বলে জানা গেছে।

প্রকল্প পরিচালকের সঙ্গে দেখা করা যেন মন্ত্রণালয়ে সচিব বা মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার চেয়েও কঠিন। অফিসে বসানো হয়েছে তিন স্তরের নিরাপত্তা ফটক। ঠিকাদার, সাংবাদিক বা সাধারণ কেউ তার অনুমতি ছাড়া ভেতরে প্রবেশ করতে পারেন না। সিকিউরিটি স্টাফদের আচরণও অত্যন্ত রূঢ়।

অনিয়মের পাহাড় জমে ওঠায় মন্ত্রণালয় থেকে তাকে শোকজ করা হয়েছে। বিলাসবহুল অফিস ও অবৈধ নিয়োগের বিষয়ে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। এসব বিষয়ে বক্তব্য জানতে সাংবাদিকরা যোগাযোগ করলে পিডি এনামুল কবির চরম অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন। তিনি প্রশ্নের উত্তর দিতে অস্বীকৃতি জানান এবং উল্টো সাংবাদিকদের ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি দেন।

তার এই অঢেল সম্পদের উৎস এবং ক্ষমতার দাপট নিয়ে বর্তমানে এলজিইডির ভেতরে-বাইরে চলছে তোলপাড়। শিগগিরই তার বিরুদ্ধে ব্যাপক তদন্ত শুরু হতে যাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button