হজরত শুআইব (আ.)-এর পরিবার: সততা ও লজ্জাশীলতার অনন্য দৃষ্টান্ত
ইসলামিক বিচিত্রা ডেস্ক: কুরআনের বর্ণনায় উঠে এসেছে বিভিন্ন নবী ও তাঁদের পরিবারের শিক্ষণীয় জীবনাচার। এর মধ্যে মাদিয়ানের নবী হজরত শুআইব (আ.)-এর পরিবার সততা, ব্যবসায়িক ন্যায়পরায়ণতা এবং আল্লাহভীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। দুর্নীতিগ্রস্ত এক সমাজে বসবাস করেও কীভাবে একটি পরিবারকে আদর্শের ওপর টিকিয়ে রাখা যায়, তার শিক্ষা মেলে এই নবীর জীবনীতে।
মাদিয়ান সম্প্রদায় ছিল ব্যবসায়িক অসততায় লিপ্ত। মাপে কম দেওয়া, ওজনে কারচুপি এবং ধোঁকাবাজি ছিল তাদের নিত্যদিনের অভ্যাস। এমন এক ঘুনে ধরা সমাজে হজরত শুআইব (আ.) তাঁর পরিবারকে গড়ে তুলেছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন ধাঁচে। তিনি তাঁর স্ত্রী, সন্তান ও আত্মীয়-স্বজনদের শিখিয়েছিলেন, “একজন ইমানদারের পরিবার কখনোই প্রতারণার আশ্রয় নিতে পারে না।”
পরিবারের প্রতিটি সদস্যের অন্তরে তিনি গেঁথে দিয়েছিলেন তাওয়াক্কুল বা আল্লাহর ওপর ভরসার শিক্ষা। পবিত্র কুরআনের সুরা হুদের ৮৮ নম্বর আয়াতে তাঁর এই বিশ্বাসের প্রতিফলন দেখা যায়, যেখানে তিনি বলেছিলেন— “আমার সাফল্য তো কেবল আল্লাহরই কাছ থেকে।” অর্থাৎ, ব্যবসা ও রিজিকের মালিক আল্লাহ, তাই অসৎ উপায়ে সম্পদ উপার্জনের কোনো প্রয়োজন নেই।
সৎ পথে চলা মানুষগুলো অনেক সময় সমাজের চোখে ‘দুর্বল’ বা ‘শত্রু’ হিসেবে বিবেচিত হয়। শুআইব (আ.)-এর পরিবারকেও এই চরম পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। কেবল সৎ ব্যবসা এবং অন্যায়ের প্রতিবাদ করার কারণে মাদিয়ানবাসী তাদের সমাজচ্যুত করার হুমকি দেয়।
পবিত্র কুরআনের সুরা আল-আ‘রাফের ৮৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, অহংকারী সমাজপতিরা তাঁকে বলেছিল, “হে শুআইব! আমরা তোমাকে এবং তোমার সঙ্গে যারা ঈমান এনেছে, সবাইকে আমাদের জনপদ থেকে বের করে দেব।” তবুও শত হুমকি ও নিপীড়নের মুখেও এই পরিবারটি সত্যের পথ থেকে বিচ্যুত হয়নি।
শুআইব (আ.)-এর পরিবারের আরেকটি বড় বৈশিষ্ট্য ছিল নারীদের পর্দা ও লজ্জাশীলতা। সুরা আল-কাসাসের ২৩ থেকে ২৫ নম্বর আয়াতে হজরত মুসা (আ.)-এর সঙ্গে শুআইব (আ.)-এর কন্যাদের সাক্ষাতের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। সেখানে দেখা যায়, অন্য পুরুষদের কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত দুই বোন পানির জন্য একপাশে অপেক্ষা করছিলেন।
পরবর্তীতে যখন তাদের একজন মুসা (আ.)-কে ডাকতে আসেন, তখন তার চালচলন সম্পর্কে কুরআনে বলা হয়েছে, “সে অত্যন্ত লজ্জাশীলভাবে হেঁটে এল।” এই বর্ণনা প্রমাণ করে যে, শুআইব (আ.) তাঁর কন্যাদের চারিত্রিক পবিত্রতা ও পরহেজগারির শিক্ষা দিয়ে বড় করেছিলেন।
এই পরিবারের আভিজাত্য ও মর্যাদার বিষয়টি হাদিস শরীফেও উঠে এসেছে। জামে তিরমিজির ৩১৫৫ নম্বর হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) উল্লেখ করেছেন যে, মুসা (আ.) যাকে বিয়ে করেছিলেন, তিনি ছিলেন একজন সৎ নবীর কন্যা। অর্থাৎ, মুসা (আ.)-এর সঙ্গে শুআইব (আ.)-এর কন্যার বিবাহ এই পরিবারের পবিত্রতা ও মর্যাদাকে আরও সুদৃঢ় করে।
হজরত শুআইব (আ.)-এর পরিবারের এই ঘটনা থেকে বর্তমান সময়ের জন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা পাওয়া যায়:
১. রিজিকের জন্য সম্পূর্ণরুপে আল্লাহর ওপর ভরসা করা।
২. ব্যবসায়িক লেনদেনে সততা বজায় রাখা ও প্রতারণা পরিহার করা।
৩. পরিবারের সদস্যদের মধ্যে লজ্জাশীলতা ও ধর্মীয় অনুশাসন গড়ে তোলা।
৪. সমাজের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেও নৈতিকতায় অটল থাকা।
সৎ ও আল্লাহভীরু পরিবারকে আল্লাহ শেষ পর্যন্ত বিজয় দান করেন, মাদিয়ানের এই ঘটনা তারই প্রমাণ।



