নিজস্ব প্রতিবেদক: দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) কঠোর নির্দেশনা উপেক্ষা করে জব্দ করা ব্যাংক হিসাব থেকে প্রায় ১০০ কোটি টাকা তুলে নেওয়ার চাঞ্চল্যকর অভিযোগ উঠেছে ‘ই-লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং লিমিটেড’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুদ আলমের বিরুদ্ধে। সাবেক ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেলের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে পরিচিত মাসুদ আলমের বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের তোয়াক্কা না করে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ স্থানান্তরের ঘটনায় ব্যাংক পাড়া ও প্রশাসনিক মহলে তোলপাড় শুরু হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অধীন ‘ই-লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং’ প্রকল্পের আওতায় দুই দফায় মোট ৪৮ কোটি টাকা (প্রতি ধাপে ২৪ কোটি) বিল হিসেবে মাসুদ আলমের প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে জমা হয়। যদিও সন্দেহজনক লেনদেনের কারণে দুদক ও বিএফআইইউ আগেই মাসুদ আলম, তার স্ত্রী এবং পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ (ফ্রিজ) রাখার নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু ব্যাংকিং খাতের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে ৩০ জুন ও ৩০ সেপ্টেম্বর ভিত্তিক জমাকৃত বিলের টাকা অত্যন্ত কৌশলে উত্তোলন করে নেওয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে, উত্তোলিত অর্থের একটি বড় অংশ পলাতক সাবেক ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল এবং কারাগারে থাকা সাবেক সচিব মেজবাহ উদ্দিনের কাছে পাচার করা হয়েছে।
এ ঘটনায় সিআর মামলা নং-৪৯৯/২০২৫ এবং দণ্ডবিধির ১৪৩, ১৪৭, ১৪৮, ৩২৬, ৩০৭, ১১৪ ও ১০৯ ধারাসহ বিশেষ ক্ষমতা আইনে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারি নির্দেশ অমান্য করে জব্দ হিসাব থেকে টাকা বের করে নেওয়ার নজির খুব একটা দেখা যায় না। প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় থাকার কারণেই মাসুদ আলম এমন বেপরোয়া কাণ্ড ঘটাতে সক্ষম হয়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে আরও বিস্ফোরক তথ্য। অভিযোগ রয়েছে, মাসুদ আলমের প্রতিষ্ঠান ৩০০ কোটি টাকার একটি সরকারি প্রকল্প বাগিয়ে নিতে বর্তমান যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার তৎকালীন এপিএস মোয়াজ্জেম হোসেনকে প্রায় ১০ কোটি টাকা ঘুষ প্রদান করেছে। এছাড়া প্রকল্প পরিচালক মো. আব্দুল হামিদ খানের বিরুদ্ধেও অনৈতিক সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। রাজনৈতিক প্রভাব, ঘুষ ও উচ্চপর্যায়ের তদবিরের জোরেই গুণগত মানহীন একটি প্রতিষ্ঠানকে এত বড় প্রকল্পের দায়িত্ব দেওয়া হয় বলে আইটি বিশেষজ্ঞদের মত।

মাসুদ আলমের অতীত ঘেঁটে জানা যায়, তিনি একসময় ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। গত জুলাই মাসে সংঘটিত ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় তার বিরুদ্ধে উসকানি, হত্যা এবং সরকারি সম্পদ ধ্বংসের অভিযোগে প্রায় ৭০টি মামলা রয়েছে। এমনকি গণহত্যার মতো গুরুতর অভিযোগে তার নাম আসা সত্ত্বেও তিনি নতুন সরকারের আমলে প্রকল্পের কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন, যা প্রশাসনের অভ্যন্তরেও প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
ব্যবসায়িক জগতে মাসুদ আলম ‘প্রমিস গ্রুপ’-এর কর্ণধার হিসেবে পরিচিত। এর আগে ‘নগদহাট বাংলাদেশ লিমিটেড’ নামে এমএলএম ব্যবসা খুলে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। পরবর্তীতে নাম বদলে ‘প্রমিস মার্ট’, ‘প্রমিস অ্যাসেট’, ‘প্রমিস টেক’সহ প্রায় ১৫টি কোম্পানি খুলে তিনি একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন।
তার সম্পদের পরিমাণ নিয়েও রয়েছে ধোঁয়াশা। ২০২৪ সালের এপ্রিলে শরীয়তপুরের গোসাইরহাট উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে লড়ার সময় তিনি যে হলফনামা জমা দিয়েছিলেন, সেখানে তার নিট সম্পদ দেখানো হয় ৯ কোটি ৯৫ লাখ ৩১ হাজার টাকা এবং বার্ষিক আয় মাত্র ২১ লাখ টাকা। তবে দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে ধারণা করা হচ্ছে, তার প্রকৃত সম্পদের পরিমাণ হলফনামার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। তিনি কৌশলে বিপুল সম্পদ গোপন করেছেন।
ইতোমধ্যে দুদক মাসুদ আলম ও তার স্ত্রীর বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। পাশাপাশি দেশের সব ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে চিঠি দিয়ে তাদের সম্পদের বিস্তারিত তথ্য তলব করা হয়েছে। প্রমিস গ্রুপের সন্দেহভাজন কর্মকর্তাদেরও নজরদারিতে রাখা হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ই-লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং লিমিটেডের দাপ্তরিক ফোন নম্বরগুলো বন্ধ এবং কার্যক্রম স্থবির হয়ে আছে। আইটি খাতের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মাসুদ আলমের প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আগে থেকেই ভুয়া বিল ভাউচার, নিম্নমানের প্রশিক্ষণ এবং অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ ছিল। এরপরও বিতর্কিত এই প্রতিষ্ঠানকে ৩০০ কোটি টাকার প্রকল্প দেওয়া এবং জব্দ হিসাব থেকে টাকা উত্তোলনের সুযোগ করে দেওয়া রাষ্ট্রের আর্থিক নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি।
এ বিষয়ে দুদক ও বিএফআইইউর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, জব্দ হিসাব থেকে কীভাবে টাকা উত্তোলন করা হলো, তা খতিয়ে দেখতে ব্যাংকগুলোর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তদন্তে সত্যতা মিললে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।



