মদিনা সনদ: বিশ্বের প্রথম লিখিত সংবিধান ও অমুসলিমদের অধিকার রক্ষার অনন্য দলিল
ধর্ম ও জীবন ডেস্ক: মানব সভ্যতার ইতিহাসে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সুশাসনের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত মদিনা সনদ। আজ থেকে প্রায় ২১০০ বছর আগে, ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) মক্কা থেকে মদিনায় (তৎকালীন ইয়াসরিব) হিজরত করার পর যে ঐতিহাসিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন, তাই আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। মুসলিম, ইহুদি ও পৌত্তলিকদের সমন্বয়ে গঠিত সেই রাষ্ট্রকাঠামো পরিচালিত হতো ‘মদিনা সনদ’ বা ‘মদিনার সংবিধান’ অনুযায়ী, যা পৃথিবীর প্রথম লিখিত সংবিধান হিসেবে স্বীকৃত।
তৎকালীন মদিনার সামাজিক প্রেক্ষাপট ছিল সংঘাতপূর্ণ। আউস ও খাযরাজ গোত্রসহ বিভিন্ন ইহুদি সম্প্রদায়ের মধ্যে দীর্ঘদিনের বিবাদ মিটিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মহানবী (সা.) এই ঐতিহাসিক চুক্তিপত্র প্রণয়ন করেন। মদিনা সনদের মাধ্যমে গঠিত রাষ্ট্রটি ছিল বহু-সাম্প্রদায়িক। এই সনদের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল ‘উম্মাহ’ বা একটি অখণ্ড জাতি গঠন, যেখানে মুসলিম ও অমুসলিম নির্বিশেষে সবাই সমান নাগরিক অধিকার ভোগ করত।
রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর স্বীকৃতি এবং সর্বোচ্চ বিচারকের ক্ষমতা ছিল এই সনদের অন্যতম দিক। তবে সনদের সবচেয়ে বৈপ্লবিক ধারাটি ছিল ধর্মীয় স্বাধীনতা। চুক্তিতে স্পষ্ট করা হয় যে, মুসলিম ও অমুসলিমরা নিজ নিজ ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন করবে এবং কেউ অন্যের ধর্মীয় বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না। এছাড়া মদিনার ওপর যেকোনো বহিঃশত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করতে সকল সম্প্রদায় সম্মিলিতভাবে কাজ করার অঙ্গীকার করে। বিচারকার্যের ক্ষেত্রেও কুরআন ও সুন্নাহর পাশাপাশি রাষ্ট্রপ্রধানের সিদ্ধান্তকে চূড়ান্ত বলে মেনে নেওয়া হয়। ইহুদিদের তাদের পূর্বের অবস্থানে বহাল রাখা হয় এবং রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত না করার শর্তে তাদের পূর্ণ ধর্মীয় ও সামাজিক অধিকার দেওয়া হয়।
ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমরা ‘আমানত’
ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় অমুসলিম নাগরিকদের বা ‘জিম্মি’দের অবস্থান অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ। ইসলামি ফিকহ অনুযায়ী, রাষ্ট্রের অমুসলিম নাগরিকরা হলেন আল্লাহর পক্ষ থেকে দেওয়া ‘আমানত’। অর্থাৎ, তাদের জান, মাল, সম্মান ও ধর্ম রক্ষার দায়িত্ব খোদ রাষ্ট্রের এবং মুসলিম সমাজের।
মহানবী (সা.) ও খুলাফায়ে রাশেদীনের শাসনামল পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, অমুসলিমদের নিরাপত্তা ও অধিকার রক্ষাকে কতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আমানত হিসেবে তাদের অধিকারগুলো প্রধানত চারটি ভাগে বিভক্ত:
১. জান ও মালের নিরাপত্তা: ইসলামী রাষ্ট্রে একজন অমুসলিম নাগরিকের রক্তের মূল্য একজন মুসলিমের সমান। কোনো অমুসলিম নাগরিককে হত্যা বা তার সম্পদ জবরদখল করা ইসলামে কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তাদের জান-মালের পূর্ণ নিরাপত্তা দেওয়া রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব।
২. ধর্মীয় স্বাধীনতা: পবিত্র কুরআনের ঘোষণা ‘দ্বীন গ্রহণে কোনো জবরদস্তি নেই’—এই নীতির ওপর ভিত্তি করে অমুসলিমরা তাদের উপাসনালয় সংরক্ষণ ও ধর্মীয় আচার পালনে পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করেন। তাদের পারিবারিক ও ব্যক্তিগত বিষয়গুলোতে নিজস্ব ধর্মীয় আইন মেনে চলার সুযোগ থাকে।
৩. ন্যায়বিচার ও সমতা: আইনের দৃষ্টিতে মুসলিম ও অমুসলিম সমান। নিরাপত্তা ও সুরক্ষার বিনিময়ে অমুসলিমদের ‘জিজিয়া’ কর দিতে হতো, যার ফলে তারা মুসলমানদের মতো বাধ্যতামূলক সামরিক সেবা থেকে অব্যাহতি পেত। তবে নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও দরিদ্রদের এই কর দিতে হতো না।
৪. সামাজিক মর্যাদা ও সদাচরণ: অমুসলিমদের সঙ্গে অসদাচরণ করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এ বিষয়ে মহানবী (সা.)-এর কঠোর হুঁশিয়ারি রয়েছে। তিনি বলেছেন, “যে ব্যক্তি কোনো চুক্তিবদ্ধ অমুসলিমের ওপর জুলুম করবে, তার অধিকার খর্ব করবে, সাধ্যের অতিরিক্ত বোঝা চাপাবে অথবা তার অনুমতি ছাড়া সম্পদ নিয়ে নেবে—কিয়ামতের দিন আমি তার বিপক্ষে বাদী হব।” (আবু দাউদ)
মূলত, মদিনা সনদ ও ইসলামী রাষ্ট্রনীতি প্রমাণ করে যে, ইসলামি শাসনব্যবস্থায় ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা কেবল প্রজা নন, বরং রাষ্ট্রের পবিত্র আমানত। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের এই কালজয়ী আদর্শ আজও বিশ্বজুড়ে প্রাসঙ্গিক।



