শহিদ হাদি হত্যাকাণ্ডে রাষ্ট্রীয় নীরবতা নানা প্রশ্নের জন্ম দেয়

অপরাধ বিচিত্রা ডেস্কঃ
অধ্যাপক এম এ বার্ণিক
১. অর্ধ মাসেও তদন্ত শুরু হয়নি কেন: শহিদ শরিফ ওসমান হাদি হত্যাকাণ্ডের পর অর্ধ মাসেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। অথচ এখনো পর্যন্ত রাষ্ট্রীয়ভাবে দৃশ্যমান কোনো তদন্তের অগ্রগতি জনসমক্ষে উপস্থাপিত হয়নি। এই প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হলো—জাতিসংঘ (United Nations) এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত প্রক্রিয়ায় আগ্রহ প্রকাশ করেছে এবং প্রয়োজনে সহায়তা দিতে প্রস্তুত বলে জানিয়েছে।
রাষ্ট্রের নীরবতা ও জাতিসংঘের আগ্রহ—এই দুই বিপরীত বাস্তবতা এখন প্রশ্ন তুলছে: তবে কি অভ্যন্তরীণ কোনো অদৃশ্য শক্তি এই হত্যাকাণ্ডের আততায়ীদের আড়াল করতে সক্রিয়?
২. তদন্তের দৃশ্যমান অনুপস্থিতি–রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতার সংকট: একটি আলোচিত রাজনৈতিক ও মানবাধিকার-সম্পর্কিত হত্যাকাণ্ডের পর স্বাভাবিকভাবে যেসব পদক্ষেপ প্রত্যাশিত ছিল, আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরুর ঘোষণা, তদন্ত কমিটি গঠন, নিয়মিত অগ্রগতি প্রতিবেদন, সন্দেহভাজনদের শনাক্তকরণ ও জিজ্ঞাসাবাদ, শহিদ হাদির ঘটনায় এসবের কোনোটিই জনসমক্ষে আসেনি। এমনকি তদন্ত আদৌ শুরু হয়েছে কিনা—এই প্রশ্নেরও সুস্পষ্ট উত্তর পাওয়া যায়নি। এই পরিস্থিতি রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল ভূমিকা নিয়ে গভীর অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে।
৩. জাতিসংঘের আগ্রহকেও স্বাগত জানানো হয়নি: তদন্ত শূন্যতার মধ্যেই জাতিসংঘের আগ্রহ বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। মানবাধিকার-সংক্রান্ত গুরুতর অভিযোগ, বিচারহীনতার প্রবণতা এবং রাজনৈতিক সহিংসতার ক্ষেত্রে জাতিসংঘ সাধারণত তখনই যুক্ত হতে চায়, যখন জাতীয় তদন্ত ব্যবস্থার ওপর আস্থা ক্ষীণ হয়ে পড়ে।
জাতিসংঘের এই আগ্রহ তিনটি স্পষ্ট বার্তা দেয়—
হত্যাকাণ্ডটি কেবল অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলার বিষয় নয়; এটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার প্রশ্নে রূপ নিয়েছে।
দেশীয় তদন্ত প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও কার্যকারিতা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে সংশয় তৈরি হয়েছে।
নিরপেক্ষ তদন্ত নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক অংশগ্রহণ প্রয়োজন হতে পারে।
৪. অদৃশ্য শক্তির সন্দেহ কেন ঘনীভূত হচ্ছে: যখন একটি হত্যাকাণ্ডে তদন্ত বিলম্বিত হয় প্রশাসন নীরব থাকে রাষ্ট্র নিজে উদ্যোগ না নিয়ে বাইরের আগ্রহের অপেক্ষায় থাকে তখন জনমনে প্রশ্ন ওঠে—কার স্বার্থে এই নীরবতা?
শহিদ শরিফ ওসমান হাদি ছিলেন অন্যায়, দমননীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ এক প্রতীক। ফলে তাঁর হত্যাকাণ্ড নিছক অপরাধ নয়; এটি একটি রাজনৈতিক ও আদর্শিক বার্তা বহন করে। এই বাস্তবতায় সন্দেহ জোরালো হচ্ছে—প্রভাবশালী কোনো গোষ্ঠী, ক্ষমতার অভ্যন্তরীণ অংশ বা রাজনৈতিক স্বার্থান্বেষী মহল তদন্তের গতি রুদ্ধ করতে চাইছে কি না।
৫. জাতিসংঘকে যুক্ত করা কেন জরুরি: জাতিসংঘের অংশগ্রহণ তদন্তে নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করবে প্রমাণ সংগ্রহ ও বিশ্লেষণে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড প্রয়োগ করবে, সাক্ষীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে, তদন্তের গ্রহণযোগ্যতা দেশি ও আন্তর্জাতিক উভয় পরিসরে বাড়াবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—জাতিসংঘ যুক্ত হলে তদন্ত আর গোপন থাকতে পারে না; তা স্বচ্ছ ও সময়বদ্ধ হতে বাধ্য হয়।
৬. ন্যায়বিচার বিলম্বিত হলে রাষ্ট্রই প্রশ্নবিদ্ধ হয়: ন্যায়বিচার কেবল আদালতের রায়ে সীমাবদ্ধ নয়; এটি রাষ্ট্রের নৈতিক অবস্থানও নির্ধারণ করে। শহিদ হাদির হত্যাকাণ্ডে যদি দ্রুত ও গ্রহণযোগ্য তদন্ত না হয়, তবে ইতিহাসের আদালতে রাষ্ট্রই কাঠগড়ায় দাঁড়াবে। এই প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘের আগ্রহকে হুমকি হিসেবে নয়, বরং একটি সুযোগ হিসেবে দেখা উচিত—একটি সুযোগ, যেখানে রাষ্ট্র প্রমাণ করতে পারে যে সে অপরাধীর নয়, শহিদের পক্ষে।
৭. প্রশ্ন জাগে: অর্ধ মাসের নীরবতা, দৃশ্যমান তদন্তের অনুপস্থিতি এবং একই সময়ে জাতিসংঘের আগ্রহ—এই তিনটি বাস্তবতা মিলিয়ে একটি স্পষ্ট প্রশ্ন সামনে আসে: সত্য উদঘাটনে রাষ্ট্র এগোবে, নাকি অদৃশ্য শক্তির ছায়া আরও দীর্ঘ হবে? শহিদ শরিফ ওসমান হাদির রক্ত নীরব নয়। সেই রক্ত আজ প্রশ্ন করছে—
ন্যায়বিচার হবে দেশীয় অন্ধকারে, নাকি আন্তর্জাতিক আলোর উপস্থিতিতে?



