ধরা পড়েও কীভাবে ছাড়া পেলেন কনস্টেবল

রাশেদুল ইসলামঃ
কক্সবাজার আদালতের এক নারী বিচারকের গানম্যান পুলিশ কনস্টেবল ইমতিয়াজ হোসেন ৯০ হাজার পিস ইয়াবাসহ হাতেনাতে ধরা পড়েও কীভাবে ছাড়া পেলেন এবং উদ্ধার হওয়া ইয়াবার ভাগ কাদের পকেটে ঢুকেছে-এ নিয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে।
সোমবার অপরাধ বিচিত্রায় সংবাদ প্রকাশের পর চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) ও কক্সবাজার জেলা পুলিশ ছাড়াও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থা এ বিষয়ে কাজ শুরু করেছে। মঙ্গলবার স্বপ্রণোদিত হয়ে একটি পৃথক ‘মিস কেস’ নথি খুলেছেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট এসএম আলাউদ্দিন মাহমুদ। একজন উপ-পুলিশ কমিশনারকে এ বিষয়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন এই আদালত।
যদিও সিএমপির বাকলিয়া থানা পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, নগরীর নতুন ব্রিজ এলাকার চেকপোস্টে প্রতিবেদনে উল্লেখিত সময়ে কাউকে আটক করা হয়নি এবং ইয়াবা উদ্ধারের ঘটনা ঘটেনি। তবে অভিযুক্ত পুলিশ কনস্টেবল ইমতিয়াজ হোসেন নিজেই এক পুলিশ সদস্যের কাছে পুরো ঘটনা খুলে বলেছেন। কীভাবে ইয়াবাসহ ধরা পড়েও তিনি ছাড়া পেয়েছেন তার আদ্যোপান্ত রয়েছে ওই কথোপকথনে।
পুলিশ সদস্যের কাছে ইমতিয়াজের স্বীকারোক্তি : এক ‘বড় ভাই’ সম্বোধন করা পুলিশ সদস্যের কাছে ইমতিয়াজ হোসেন স্পষ্টভাবে স্বীকার করেছেন, বাকলিয়া থানার পুলিশ সদস্যরা তার পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর এ ধরনের মাদক পাচারের সঙ্গে আর কখনো জড়িত না থাকার শর্তে তাকে ছেড়ে দেন। একই সঙ্গে বিষয়টি যেন কখনো কারও সঙ্গে শেয়ার না করা হয়, সে শর্তও দেওয়া হয়েছে। ইমতিয়াজ ওই পুলিশ সদস্যের কাছে বলেন, গত ৮ ডিসেম্বর রাতে তিনি ‘দেশ ট্রাভেল’ পরিবহণের একটি হুন্দাই গাড়িতে কক্সবাজার থেকে ঢাকার দিকে যাচ্ছিলেন।
সোমবার রাত প্রায় ২টার দিকে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী ব্রিজের টোলপ্লাজা পার হওয়ার পর চট্টগ্রামের বাকলিয়া থানার চেকপোস্টে গাড়িটি থামানো হয়। পরে তাকে (ইমতিয়াজকে) গাড়ি থেকে নামিয়ে ব্যাগসহ তল্লাশি করা হয়। রাত প্রায় সোয়া ২টার দিকে পুলিশ বক্সে নিয়ে এসআই মো. আল আমিনের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল তার ব্যাগ তল্লাশি করে। পরে বাকলিয়া থানার ওসি (তদন্ত) তানভীর আহমেদ ঘটনাস্থলে আসেন। প্রায় তিন ঘণ্টা তাকে আটকে রাখা হয়। এ সময় ঊর্ধ্বতন অফিসারদের সঙ্গে কথা বলেন এসআই আল আমিন ও ইনস্পেকটর তানভীর আহমেদ। ভোরে তাকে একটি বাসে তুলে দিলে, ইমতিয়াজ সেই বাসে কুমিল্লা চলে যায়।
এ বিষয়ে আংশিক সত্য স্বীকার করে কনস্টেবল ইমতিয়াজ বলেন, ‘তাকে কয়েক ঘণ্টা আটক রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। ভোরের দিকে অন্য একটি গাড়িতে তুলে দেয় বাকলিয়া থানা পুলিশ।’ মাদকের সঙ্গে জড়িত না থাকলে কেন তিনি হয়রানির পরও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে যাননি? এই প্রশ্নে তিনি জানান, ‘চাকরি চলে যাবে’ এই ভয়েই চুপ ছিলেন। তবে ইয়াবা উদ্ধার না হলে একজন পুলিশ সদস্যকে গভীর রাত পর্যন্ত কেন দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো? আর যদি ইয়াবা উদ্ধার হয়ে থাকে, তাহলে সেই ৯০ হাজার ইয়াবা কোথায় গেল? ইমতিয়াজের এই স্বীকারোক্তি পুরো ঘটনাকে শুধু একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং পুলিশের ভেতরে সক্রিয় মাদক সিন্ডিকেটের অস্তিত্বের দিকেই ইঙ্গিত করেছে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বাকলিয়া থানার সেকেন্ড অফিসার এসআই মো. আল আমিন এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি বলে দাবি করেন। তিনি প্রতিবেদকের সঙ্গে দেখা করে একান্তে বসার প্রস্তাব দেন।
সিএমপির একজন ঊর্ধ্বতন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ইয়াবা আত্মসাতের অভিযোগের বিষয়টি আংশিকভাবে স্বীকার করে বলেন, ‘ইয়াবা উদ্ধারের বিষয়টি আমি শুনেছি। এর সঙ্গে বাকলিয়া থানার সেকেন্ড অফিসার এসআই আল আমিন ছাড়াও ওসি এবং ইনস্পেকটরসহ (তদন্ত) আরও অনেকের নাম আসছে। তবে প্রমাণ ছাড়া ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন।’ তিনি এ বিষয়ে তথ্য-প্রমাণ দিয়ে সহযোগিতা করার অনুরোধও জানান।
জানতে চাইলে সিএমপির উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) মো. আলমগীর হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ‘বিভিন্ন মাধ্যম থেকে শুনে গত ১২ ডিসেম্বর বাকলিয়া থানার সংশ্লিষ্ট অফিসারদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলাম। কিন্তু কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। বিশেষ করে এ ঘটনায় কোনো অভিযোগকারী না থাকায় আমরা আগাতে পারিনি। এখন আমরা কনস্টেবল ইমতিয়াজকে জিজ্ঞাসাবাদ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
এদিকে আদালতে স্বপ্রণোদিত মিসকেস নথি খোলার পর ইয়াবা উদ্ধার, বিচারকের গানম্যানকে ছেড়ে দেওয়া এবং ইয়াবা গায়েবের ঘটনাটি তদন্ত করে আগামী ১২ জানুয়ারির মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট এসএম আলাউদ্দিন মাহমুদ মঙ্গলবার এই নির্দেশ দেন।
কক্সবাজার জেলার পুলিশ সুপার এএনএম সাজেদুর রহমান অপরাধ বিচিত্রাকে বলেন, এ বিষয়ে কক্সবাজার জেলা আদালতের একজন বিচারক আমাকে ফোন করেছেন। আমরা তদন্ত করছি। ঘটনা প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট সবার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।



