বাকলিয়ার পুলিশ গিলে খেলো ৯০ হাজার ইয়াবা

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ চট্টগ্রামে বিচারকের গানম্যানকে আটক করে ৯০ হাজার ইয়াবা গায়েব কাঠগড়ায় বাকলিয়া থানা পুলিশ বিস্ফোরক অনুসন্ধানে বেরিয়ে এলো চাঞ্চল্যকর তথ্য।
চট্টগ্রামের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি অংশের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে।অভিযোগ উঠেছে তারা নাকি মাদক জব্দ করার পর মামলার পরিবর্তে ব্যক্তি বিশেষকে ছেড়ে দিয়েছে এবং বিপুল পরিমাণ ইয়াবাও গায়েব করেছে।যারা দেশের যুবসমাজকে মাদকের ছোবল থেকে রক্ষা করবে তারাই যদি অভিযুক্ত হয় তাহলে প্রশ্ন উঠবে না কার বিরুদ্ধে উঠবে।আর সেই প্রশ্নই এখন চট্টগ্রাম শহরের আনাচে কানাচে ঘুরপাক খাচ্ছে।যারা মাদক ধ্বংস করবে তারাই এখন বক্ষক, রক্ষক যখন ভক্ষক।এই মাদকের ছোবলে প্রতিনিয়ত ধ্বংস হচ্ছে শত শত যুবক।পরিবার হারাচ্ছে স্বাভাবিক জীবন।সমাজ হারাচ্ছে নৈতিক শক্তি। এই পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ নিঃসন্দেহে বিস্ফোরক ও উদ্বেগজনক।
ঘটনাটি ঘটেছে চলতি মাসের ৮ ডিসেম্বর রাত দেড়টা থেকে তিনটার মধ্যে।বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন এবং অনুসন্ধানী তথ্য থেকে জানা গেছে কক্সবাজার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল দুই এর বিচারকের গানম্যান কনস্টেবল ইমতিয়াজ চট্টগ্রামের বাকলিয়া থানার কর্ণফুলী ব্রিজসংলগ্ন চেকপোস্টে পুলিশের হাতে আটক হন।তার কাছে থাকা দুটি ব্যাগে নাকি বিপুল পরিমাণ ইয়াবা উদ্ধার হয়েছিল।পুলিশের একটি সূত্র দাবি করেছে ব্যাগ দুটিতে ছিল প্রায় ৯০ হাজার পিস ইয়াবা।যদিও অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যরা প্রকাশ্যে এমন কোন জব্দের ঘটনা ঘটেনি বলে দাবি করেছেন।
অনুসন্ধানে উঠে আসে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য।জানা যায় ৮ ডিসেম্বর রাত দশটা পনের মিনিটে কক্সবাজারের কলাতলী কাউন্টার থেকে ঢাকাগামী দেশ ট্রাভেলস নামের বাসের ই ওয়ান সিটের টিকিট কেটেছিলেন কনস্টেবল ইমতিয়াজ।যদিও টিকিটে যাত্রা শুরুর স্থান হিসেবে লেখা ছিল চকরিয়া।টিকিটে যে মোবাইল নাম্বর ব্যবহার করা হয়েছিল সেটি নিবন্ধিত ছিল ঢাকার ধামরাই এলাকার এক বাহারউদ্দিন নামের ব্যক্তির জাতীয় পরিচয়পত্রের মাধ্যমে।
আরেকটি প্রশ্ন উঠেছে তিনি নাকি সেদিন বিচারক বা জেলা পুলিশের কাছ থেকে কোন ছুটি নেননি।
বাসের সুপারভাইজার মিজান সাংবাদিকদের জানান কর্ণফুলী ব্রিজ পার হয়ে বাকলিয়া থানার চেকপোস্টে গাড়িটি থামানো হয় এবং তল্লাশি করা হয়।ইমতিয়াজ নিজেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য হিসেবে পরিচয় দিলে তাকে পুলিশ বক্সে নিয়ে যায় বাকলিয়া থানাপুলিশ। এরপর বাসের বক্স থেকে ইমতিয়াজের দুটি ব্যাগ নামিয়ে নেয়া হয়।ব্যাগ দুটির তালা বন্ধ অবস্থায় ছিল ।প্রায় ত্রিশ মিনিট পর বাসটিকে ইমতিয়াজকে রেখে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে দেয় পুলিশ।সেই রাতে আরও তিনটি স্থানে বাসটি তল্লাশির মুখোমুখি হয় বলে জানান অত্র গাড়ির সুপারভাইজার।
ইমতিয়াজের পেছনের সিটে বসা আরেক যাত্রী জানিয়েছেন পুলিশ এসে সামনে বসা ওই ব্যক্তিকে নামিয়ে নেয় এবং পরে আর তাকে বাসে উঠতে দেখা যায়নি।ফলে তিনি ছাড়াই বাসটি ঢাকার উদ্দেশ্যে চলে যায়।পুলিশের একাধিক সূত্র দাবি করেছে সেদিন ইমতিয়াজের সঙ্গে থাকা ব্যাগে ছিল ৯০ হাজার ইয়াবা ট্যাবলেট।কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় বাকলিয়া থানার কোনও কর্মকর্তা প্রকাশ্যে ওই তল্লাশি বা ইয়াবা জব্দের কথা স্বীকার করেননি।বরং ঘটনার বিষয়টি পুরোপুরি অস্বীকার করে আসছেন অনেকেই।
অভিযোগ উঠেছে সেদিন তাকে আটক করে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়।সেখানে উপস্থিত ছিলেন ওসি তদন্ত তানভীর আহমেদ সেকেন্ড অফিসার আল আমিনসহ আরও কয়েকজন এসআই এএসআই পুরুষ কনস্টেবল এবং দুইজন মহিলা কনস্টেবল।এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন কয়েকজন সোর্স।অভিযোগ রয়েছে সেখানে ইয়াবা জব্দের একটি তালিকা তৈরি করা হয় এবং ইমতিয়াজের কাছ থেকে একটি জবানবন্দী নেওয়া হয় যেখানে স্বাক্ষরও করানো হয়।এরপর নাকি কাউকে কিছু না জানানোর শর্তে কয়েক ঘণ্টা পর তাকে কুমিল্লাগামী বাসে তুলে দেওয়া হয়। যদিও এসব তথ্যের কোনও সরকারি নিশ্চিতকরণ পাওয়া যায়নি। সংশ্লিষ্টরা বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতেও নারাজ।
এদিকে কনস্টেবল ইমতিয়াজও প্রথম দিকে নিজেকে ওই ঘটনায় জড়িত বলে স্বীকার করেননি।তিনি নিজেকে ইমতিয়াজ নামের ব্যক্তি হিসেবে অস্বীকার করেছেন বলেও জানা গেছে।তবে এক পুলিশ সদস্যের সঙ্গে আলাপচারিতায় তিনি নাকি স্বীকার করেছেন যে সেদিন তার কাছ থেকে ইয়াবা উদ্ধার হয়েছিল। এসব তথ্য গণমাধ্যমে আসতেই বিষয়টি নিয়ে শুরু হয় জোর আলোচনা।
তার মোবাইল ফোনের কললিস্ট এবং লোকেশন ডেটা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে গত কয়েক মাসে তিনি কক্সবাজার থেকে ঢাকা এবং ঢাকা থেকে কক্সবাজার একাধিকবার যাতায়াত করেছেন।১৩ অক্টোবর ঢাকা গেছেন ১৭ অক্টোবর ফিরে এসেছেন।এরপর ১৫ নভেম্বর গেছেন ১৭ নভেম্বর ফিরেছেন।আবার ২২ নভেম্বর গেছেন এবং ২৪ নভেম্বর কক্সবাজার ফিরেছেন।
সর্বশেষ ৮ ডিসেম্বর রাতে তিনি ঢাকা যাচ্ছিলেন এবং বাকলিয়া চেকপোস্টে আটক হন।এরপর কীভাবে তিনি কুমিল্লায় তার গ্রামের বাড়িতে পৌঁছে গেলেন তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
এখন প্রশ্ন উঠেছে যদি সত্যিই ৯০ হাজার ইয়াবা উদ্ধার হয়ে থাকে তাহলে সেটি কোথায়।কেন তা জব্দ তালিকায় প্রকাশ করা হলো না।কেন মামলা হয়নি।আর যদি এমন কিছু না ঘটে থাকে তাহলে এত আলোচনার সূত্রপাত কীভাবে।এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই বিষয়টি গড়িয়েছে আদালত পর্যন্ত।চট্টগ্রামের মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট এস এম আলাউদ্দিন মাহমুদ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন আমলে নিয়ে স্বপ্রণোদিত হয়ে মামলা গ্রহণ করেছেন।
আদালত সিএমপির দক্ষিণ বিভাগের উপ কমিশনারকে আগামী ১২ জানুয়ারির মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।এতে স্পষ্ট বোঝা যায় বিষয়টি আদালতও গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতে নারাজ।
কেউ কেউ জানিয়েছেন বিষয়টি যেহেতু আদালতে গেছে তাই মন্তব্য করা সমীচীন নয়।অন্যদিকে সাধারণ মানুষ এবং সচেতন মহলের মধ্যে এ নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে বিরাট উদ্বেগ।কারণ যারা আইন রক্ষা করবেন এবং মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবেন তারাই যদি অভিযুক্ত হন তাহলে আইনের প্রতি মানুষের আস্থা কোথায় থাকবে।ইতিমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এ নিয়ে চলছে তুমুল আলোচনা সমালোচনা।
বাংলাদেশে ইয়াবা একটি ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধিতে রূপ নিয়েছে। প্রতিদিন অসংখ্য তরুণ তরুণী এই মাদকের নেশায় জড়িয়ে পড়ছে। পরিবার ভেঙে যাচ্ছে। অপরাধ বাড়ছে। অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আত্মহত্যা খুন ধর্ষণসহ নানান অপরাধের সঙ্গে মাদকের যোগসূত্র পাওয়া যাচ্ছে। এই মাদক দমন করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রতিনিয়ত অভিযান পরিচালনা করছে।অসংখ্য মামলা হচ্ছে। হাজারো মানুষ গ্রেপ্তার হচ্ছে।এমন পরিস্থিতিতে আইন রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য জড়িত থাকার অভিযোগ পুরো ব্যবস্থাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।
তাই এই ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত এখন সময়ের দাবি। ঠিক কী ঘটেছিল সেদিন রাতে। কনস্টেবল ইমতিয়াজের কাছে সত্যিই কি এত বিপুল পরিমাণ ইয়াবা ছিল। থাকলে সেটি কোথায় গেল।কেন মামলা হলো না। কারা কারা সংশ্লিষ্ট ছিলেন। কোনও প্রভাবশালী গোষ্ঠীর ভূমিকা ছিল কি না। সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতে হবে স্বচ্ছ ও স্বাধীন তদন্তের মাধ্যমে। দোষীদের আইনের আওতায় আনতে হবে এবং নিরপরাধ কেউ থাকলে তাকেও মুক্ত করতে হবে।
আইনের চোখে সবাই সমান।
পুলিশের সদস্য হলেও তিনি আইনের বাইরে নন।বরং দায়িত্ব ও জবাবদিহিতার জায়গাটি তাদের জন্য আরও বড়।একারণে এই ঘটনার সঠিক তদন্ত এবং সত্য উদঘাটন শুধু একটি ঘটনার বিচার নয় এটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভাবমূর্তি রক্ষারও প্রশ্ন।জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে যেকোনও অপকর্মের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নিশ্চিত করতে হবে।
সবশেষে আবারও বলতে হয় যারা মাদক ধ্বংস করবে তারাই যদি বক্ষক রক্ষক হয়ে ভক্ষকে পরিণত হয় তাহলে দেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকারের দিকে এগোবে। যুবসমাজকে বাঁচাতে হলে মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হতে হবে নিরবচ্ছিন্ন। আইন রক্ষাকারী প্রতিটি সদস্যকে হতে হবে সৎ ও দায়বদ্ধ। আর এই ঘটনার স্বচ্ছ তদন্তের মধ্য দিয়েই তার প্রমাণ দিতে হবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে।



