রাজনীতি

জামায়াত জোটে এনসিপির ভেতর তোলপাড় নারী নেতৃত্বের একের পর এক সরে দাঁড়ানো

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে নতুন করে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক সমঝোতায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত ঘিরে জাতীয় নাগরিক পার্টি এনসিপির ভেতরে বড় ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়েছে।জামায়াতের সঙ্গে আসন সমঝোতায় আপত্তি জানিয়ে একের পর এক নারী নেতা দল ছাড়ছেন বা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন।এতে জুলাই মাসের গণঅভ্যুত্থান থেকে উঠে আসা তরুণদের নেতৃত্বে গড়া নতুন এই দলটি বড় ধাক্কা খেয়েছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।এনসিপির অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি এখন এমন এক অবস্থায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে যেখানে নেতৃত্বের সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন উঠছে এবং ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে দলটির অবস্থান কতটা দৃঢ় থাকবে তা নিয়েও তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা।

এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্য সচিব তাসনিম জারা জামায়াতের সঙ্গে জোটের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন।একই সঙ্গে তিনি জানিয়েছেন যে ঢাকা ৯ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেবেন।ইতোমধ্যে তিনি ভোটারদের স্বাক্ষর সংগ্রহ শুরু করেছেন এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করে লিখেছেন যে আদর্শের সঙ্গে আপস করা তার পক্ষে সম্ভব নয়।অন্যদিকে যুগ্ম আহ্বায়ক তাজনূভা জাবীন জানান যে তিনি এনসিপি ছাড়লেও এই নির্বাচন করছেন না।তবে রাজনীতি ছাড়ছেন না বলেও উল্লেখ করেন তিনি।এ ছাড়া যুগ্ম আহ্বায়ক মনিরা শারমিন জানান যে তিনি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন যদিও দল ছাড়ছেন না।তার ভাষায় দুই থেকে তিন শ আসনে প্রার্থী দেওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পর হঠাৎ করে জোটে যাওয়া সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণার সামিল।আরেক যুগ্ম আহ্বায়ক নুসরাত তাবাসসুম জানিয়েছেন যে নির্বাচনকালীন সময়ে তিনি দলীয় কার্যক্রমে নিষ্ক্রিয় থাকবেন।তার মতে জামায়াতসহ দশ দলীয় জোটে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে দলের শীর্ষ নেতৃত্ব মূল বক্তব্য এবং দর্শন থেকে সরে গেছে।সবচেয়ে তীব্র মন্তব্য এসেছে জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্থা শারমিনের কাছ থেকে।তিনি সরাসরি বলেছেন জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতা এনসিপিকে কঠিন মূল্য দিতে বাধ্য করবে এবং এই সিদ্ধান্তকে তিনি আত্মঘাতী হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।
দলীয় সূত্রগুলো জানায় গত বৃহস্পতিবার দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের বাসায় অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে অন্তত ছয়জন নারী নেতা জামায়াতের সঙ্গে প্রায় চূড়ান্ত হয়ে যাওয়া আসন সমঝোতার বিরুদ্ধে তীব্র আপত্তি জানান। বৈঠকে তারা স্পষ্ট করে দেন যে জোট চূড়ান্ত হলে তারা একযোগে পদত্যাগ করবেন।

তাদের দাবি ছিল বিএনপির সঙ্গে জোট করা অথবা এককভাবে নির্বাচনে যাওয়া। তারা মনে করেন এনসিপি একটি উদীয়মান বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে যে আশা তৈরি করেছিল জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতা করলে সেটি নষ্ট হয়ে যাবে। তরুণ প্রজন্মের কাছে দলের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে এবং নারী নেতৃত্বের জন্য যে সাহসী উদাহরণ এনসিপি তৈরি করেছিল সেটিও ভেঙে পড়বে।

এর আগে গত শনিবার এনসিপির ৩০ জন নেতা জামায়াতের সঙ্গে জোটের বিরোধিতা করে আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামকে একটি চিঠি দেন। চিঠিতে বলা হয় জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক ইতিহাস বিশেষ করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের ভূমিকা এনসিপির ঘোষিত আদর্শ ও গণতান্ত্রিক চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। একই সঙ্গে অভিযোগ করা হয় জামায়াত এবং তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির এনসিপির নারী সদস্যদের বিরুদ্ধে অনলাইনে চরিত্রহননের চেষ্টা চালিয়েছে যা একটি আধুনিক মানবিক রাজনৈতিক দলের নীতির সঙ্গে যায় না। এ ধরনের শক্তির সঙ্গে জোট করলে এনসিপির নৈতিক অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তারা।

এনসিপির একাধিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন নারী নেতৃত্বের বড় একটি অংশ বিশ্বাস করেন যে জামায়াতের সঙ্গে জোট হলে ভবিষ্যতে নারীদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ আরও সংকুচিত হয়ে পড়বে। জামায়াতের রাজনৈতিক দর্শন নারীবান্ধব নয় বলে তাদের ধারণা এবং এই আশঙ্কা থেকেই তারা বিরোধিতার পথে হাঁটছেন।সেই সঙ্গে তারা মনে করছেন একটি নবীন রাজনৈতিক দল হিসেবে এনসিপি যে বিশ্বাসযোগ্যতার জায়গা তৈরি করেছিল সেটি এখন প্রশ্নের মুখে পড়েছে। বিশেষ করে জুলাই মাসের গণঅভ্যুত্থানের পর যখন তরুণ প্রজন্ম পরিবর্তনের দাবি তুলেছিল তখন এনসিপি সেই পরিবর্তনের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এখন সেই প্ল্যাটফর্মই যদি বিতর্কিত শক্তির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে তাহলে সাধারণ মানুষের ভরসা নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।

তাসনিম জারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া তার স্ট্যাটাসে লিখেছেন যে তিনি নিজের বিবেক এবং নৈতিক অবস্থান থেকে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি বলেছেন রাজনীতি মানে শুধু ক্ষমতা পাওয়া নয় বরং জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকা। তাজনূভা জাবীনও একইভাবে জানিয়েছেন যে তিনি কোনো অনৈতিক আপসের রাজনীতিতে থাকতে চান না।মনিরা শারমিন বলেন দলের ভেতরে এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যারা কথা বলেছেন তাদের কথা যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হয়নি। নুসরাত তাবাসসুম উল্লেখ করেন যে জোটে যাওয়ার মাধ্যমে দলটি তার প্রতিষ্ঠালগ্নের ঘোষণাপত্র থেকে সরে যাচ্ছে এবং এই অবস্থায় তিনি সক্রিয় থাকতে বিব্রত বোধ করছেন। সামান্থা শারমিন আরও বলেন এনসিপির এই সিদ্ধান্ত শুধু রাজনৈতিকভাবে নয় বরং নৈতিক দিক থেকেও ভুল বার্তা দিচ্ছে।

এই পরিস্থিতিতে রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন দলে থাকা বা না থাকা এবং নির্বাচন করা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। তিনি দাবি করেন নির্বাহী পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতেই জোটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে এবং এটি কোনো একক ব্যক্তির সিদ্ধান্ত নয়।যারা বিরোধিতা করছেন তাদের সঙ্গে আলোচনা করে বোঝানোর চেষ্টা করা হবে বলেও তিনি জানান। তার ভাষায় বৃহত্তর রাজনৈতিক বাস্তবতায় প্রভাব বিস্তারের জন্য কখনো কখনো কৌশলগত সিদ্ধান্ত নিতে হয় এবং সেটিই তারা করেছেন। তবে তার এই ব্যাখ্যায় বিরোধীতাকারী নারী নেত্রীদের অনেকে সন্তুষ্ট নন বলে জানা গেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এস এম আলী রেজা মনে করেন জুলাই মাসের গণঅভ্যুত্থানের পর এনসিপির গঠনে নারী নেতৃত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।তারা বিভিন্ন সভা সমাবেশে সরব উপস্থিতি দেখিয়েছেন এবং তরুণদের আকৃষ্ট করেছেন।এই নারী নেত্রীরা একে একে সরে গেলে দলটির জন্য সেটি বড় ধরনের হোঁচট হতে পারে।বিশেষ করে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যেখানে নারী নেতৃত্ব এখনো নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি সেখানে এনসিপি একটি ব্যতিক্রমী উদাহরণ তৈরি করেছিল।এখন সেটি ভেঙে পড়লে দলটির ব্র্যান্ড ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং ভোটারদের আস্থা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে।

আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচন এনসিপির জন্য প্রথম জাতীয় নির্বাচন।এই নির্বাচনকে সামনে রেখে দলটি তিন শ আসনে প্রার্থী দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ করে জামায়াতের নেতৃত্বাধীন জোটে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্তে শুধু বিরোধী দলগুলোই নয় বরং নিজেদের ভেতরেও তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে এনসিপি যদি এই সংকট মোকাবিলা করতে না পারে তাহলে নবীন একটি রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে তাদের টিকে থাকাই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। দলটির সামনে এখন বড় প্রশ্ন হলো জোটের সিদ্ধান্ত বহাল রেখে তারা কতটা ঐক্য বজায় রাখতে পারবে এবং সেই ঐক্যের প্রতিফলন ভোটযুদ্ধে দেখা যাবে কিনা।

এনসিপির অনেক সমর্থকই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করছেন।তারা লিখছেন যে পরিবর্তনের রাজনীতি করতে হলে পুরনো বিতর্কিত শক্তির ওপর নির্ভরশীল হওয়া উচিত নয়।আবার দলের একটি অংশ বলছেন ক্ষমতার রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারের জন্য জোট রাজনীতি বাস্তবতা এবং সেটি অস্বীকার করার সুযোগ নেই। এই দুই অবস্থানের টানাপোড়েনে এনসিপি এখন এক ধরনের সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে।সামনে যে দিনগুলো আসছে তা এনসিপির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।কারণ এই সময়ের মধ্যেই নির্ধারণ হয়ে যাবে দলটি ভাঙন সামলে নতুন করে দাঁড়াতে পারে কিনা অথবা অভ্যন্তরীণ বিরোধের চাপ সামলাতে ব্যর্থ হয় কিনা।
সব মিলিয়ে বলা যায় জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতা করে নির্বাচনী মাঠে নামার সিদ্ধান্ত এনসিপির ভেতরে যে তোলপাড় সৃষ্টি করেছে তা এখন শুধু দলের ভেতরেই সীমাবদ্ধ নেই বরং জাতীয় রাজনীতিতেও নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। নারী নেতৃত্বের একের পর এক সরে দাঁড়ানো এবং প্রকাশ্য অসন্তোষ প্রকাশ করা প্রমাণ করে যে বিষয়টি কতটা গভীর। এখন নজর থাকবে দলটির শীর্ষ নেতৃত্বের দিকে তারা কীভাবে এই সংকটের সমাধান করেন এবং ভোটের মাঠে এই বিরোধ কতটা প্রভাব ফেলতে পারে সেটিই এখন বড় প্রশ্ন হিসেবে দেখা দিচ্ছে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button