হাজতখানায় বসে গুনে গুনে টাকার বান্ডিল হাতবদল করছেন মধ্যবয়সী ওই ব্যাক্তি
থানার হাজতখানার ভেতরে হলুদ গেঞ্জি ও সাদা প্যান্ট পরে বসে রয়েছেন মধ্যবয়সী এক ব্যক্তি। তার পাশে মেঝেতে শুয়ে রয়েছেন আরও কয়েকজন। লোহার শিকের ফাঁক দিয়ে হাজতখানার ভেতর থেকে গুনে গুনে টাকার বান্ডিল হাতবদল করছেন মধ্যবয়সী ওই ব্যক্তি। ১ হাজার, ৫০০ ও ১০০ টাকার এসব বান্ডিল। হাজতের বাইরে থেকে সেই টাকার বান্ডিল গুনে কালো ও সাদা রঙের দুটি শপিং ব্যাগে রাখছেন আরও দু’জন। পাশে অস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন পোশাক পরিহিত এক পুলিশ সদস্য।
এ দৃশ্য গাজীপুর মহানগর পুলিশের (জিএমপি) টঙ্গী পূর্ব থানার হাজতখানার। টাকা লেনদেনের ৫২ সেকেন্ডের একটি ভিডিও ফুটেজ সমকালের হাতে এসেছে। সেই ভিডিওর বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাজতখানার ভেতর থেকে টাকা গুনে দিচ্ছেন মোশতাক মোশাররফ টুটুল। আর পুলিশের উপস্থিতিতে হাজতির কাছ থেকে টাকা নিচ্ছেন মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ও আরিফুর রহমান খান। কীভাবে থানা হাজতের ভেতরে হাজতির কাছে লাখ লাখ টাকা পৌঁছাল– উঠেছে সেই প্রশ্ন।
জানা গেছে, থানার হাজতখানা থেকে টাকা লেনদেনের ভিডিওটি গত ২৭ অক্টোবরের। পুলিশের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তি টুটুলের ব্যবসায়ী অংশীদার মহিউদ্দিন। টুটুল যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের দ্বৈত নাগরিক। আর আরিফ হলেন মহিউদ্দিনের সহযোগী। টুটুল ও মহিউদ্দিনের যৌথভাবে ঠিকাদারি ব্যবসা রয়েছে। টাকার লেনদেন নিয়ে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব রয়েছে। দু’জনের বাড়িই গাজীপুরে। চাঁদাবাজির অভিযোগে ২৭ অক্টোবর একটি বাহিনী তাঁকে আটক করে টঙ্গী পূর্ব থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। এর পরই থানা হাজতে বসে ব্যবসায়িক অংশীদারকে টাকা দিতে বাধ্য হন টুটুল।
এই ঘটনায় ৪ নভেম্বর সেনাপ্রধান, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা, আইজিপি, জিএমপি কমিশনারসহ আট সংস্থায় অভিযোগ দেন টুটুলের ফুফাতো ভাই আইনজীবী জিএম ইব্রাহিম হোসেন। তিনি জানান, গত ২৭ অক্টোবর রাতে উত্তরা আশকোনা হজক্যাম্প এলাকা থেকে তাঁর মামাতো ভাই টুটুলকে আটক করে টঙ্গী পূর্ব থানায় হস্তান্তর করা হয়। এমন খবর পেয়ে ইব্রাহিম থানায় গেলে ওসি কায়সার আহমেদ তাঁর পেশা সম্পর্কে জানতে চান।
আইনজীবী পরিচয় দিলে এক পুলিশ সদস্যকে ওসি বলেন, মার্কিন নাগরিক টুটুলকে গ্রেপ্তার করে থানায় দিয়েছে এবং একজন আইনজীবীকেও হাতের কাছে পেয়েছি। দুটি চাঁদাবাজি মামলা দিয়ে হাজতে রাখার নির্দেশ দেন। এর পর রাত ২টায় থানা হাজতে আটকে রাখা হয়। পুলিশ হেফাজতে থাকাকালে সকাল ৮টার দিকে টুটুলের বোন মায়া সরকারের কাছে ৭৪ লাখ টাকা দাবি করেন মহিউদ্দিন ও আরিফ। এর বিনিময়ে টুটুল ও ইব্রাহিমকে থানা থেকে ছেড়ে দেওয়া হবে বলে আশ্বাস দেন। টাকা না দিলে তাদের বিভিন্ন মিথ্যা মামলায় জড়ানোর হুমকি দেন। এ ছাড়া পুলিশকে দিয়ে মারধর করানোর ভয় দেখানো হয়। শেষ পর্যন্ত ১৯ লাখ টাকা দিতে সম্মত হন টুটুল ও ইব্রাহিমের স্বজনরা। পুলিশের সহায়তায় পরিবারের সদস্যরা থানা হাজতে টাকা নিয়ে যেতে বাধ্য হন। পরে সেই টাকা থানা হাজতের ভেতর থেকে টুটুল গনে অভিযুক্ত মহিউদ্দিন ও আরিফুলকে দেন।
অভিযোগে আরও বলা হয়, থানা হাজতে আটকে রেখে আদায়কৃত টাকার মধ্যে টঙ্গী পূর্ব থানার ওসি কায়সার আহমেদকে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা, মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে ৫০ হাজার টাকা এবং অন্যরা আরও ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা মায়া সরকারের কাছ থেকে আদায় করেন। বাকি টাকা মহিউদ্দিন ও আরিফ নিয়ে যান।
লিখিত সেই অভিযোগে বলা হয়, টুটুলকে আইনি সহায়তা দিতে থানায় গেলে ওসি বেআইনিভাবে আটক করেন। এর পর আসল ঘটনা আড়াল করে টুটুল ও ইব্রাহিমকে আসামি করে চাঁদাবাজি মামলা দায়ের করা হয়। থানা হাজতের ভেতরে অবৈধভাবে আটক রেখে মিথ্যা মামলার ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়ের ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান আইনজীবী ইব্রাহিম ও টুটুল। আরিফ বাদী হয়ে টুটুল ও ইব্রাহিমের বিরুদ্ধে যে মামলা করেন, সেই মামলায় তারা জামিন পেয়েছেন।
ভুক্তভোগী আইনজীবী ইব্রাহিম হোসেন বলেন, ওই দিন ভুল তথ্যে টুটুলকে আটক করে ওই বাহিনী। পরে তারা টঙ্গী থানায় হস্তান্তরের সময় পুলিশকে বলে দেন, তাঁর নামে কোনো মামলা না থাকলে যেন বাসায় পৌঁছে দেওয়া হয়। কিন্তু পুলিশ উল্টো তাঁকে গ্রেপ্তার দেখায়। আইনজীবী হিসেবে সহায়তা দিতে গেলে আমাকেও আটক হতে হয়েছে। আটকের পর সকালে চাঁদাবাজির মামলা দেওয়া হয়েছে। এর আগে টুটুল বা আমার নামে কোনো মামলা ছিল না।
মোহাম্মদ মহিউদ্দিন বলেন, থানা হাজতখানা থেকে টুটুলের কাছ থেকে ১৯ লাখ টাকা নেওয়ার অভিযোগ ঠিক নয়। তাঁর কাছ থেকে ১৬ লাখ টাকা নিয়েছি। তাঁর কাছে অনেক টাকা পাওনা আছে। থানায় আটকে রেখে এভাবে টাকা নিতে পারেন কিনা– জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে টুটুলের লোকের কাছে শোনেন বলে ফোনের লাইন কেটে দেন।
টঙ্গী পূর্ব থানার ওসি কায়সার আহমেদ বলেন, ঘটনার সময় আমি থানায় ছিলাম না। থানা হাজতে থাকা আসামির কাছে কীভাবে এত টাকা পৌঁছেছে, তা বলতে পারছি না। সম্ভবত আসামির স্বজনরা খাবার দেওয়ার সময় ব্যাগের ভেতর টাকাগুলো নিয়ে যান। আসামিরা সেই টাকা বাদীপক্ষকে দিয়েছেন। বাদী ওই টাকা তাদের কাছে পেতেন। তবে থানার ভেতর পুলিশের উপস্থিতিতে এভাবে টাকা লেনদেনের ঘটনা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
তিনি জানান, এ কারণে ওই সময় সেন্ট্রির দায়িত্বে থাকা কনস্টেবল মুক্তাদিরকে সাময়িক বরখাস্ত, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই আসাদুজ্জামানকে গাজীপুর মহানগর পুলিশের উত্তর বিভাগে বদলি এবং ডিউটি অফিসারকে শোকজ করা হয়েছে। চার দিন পর আমি বিষয়টি জানতে পারি। তখন ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ওসি ও তদন্ত কর্মকর্তাসহ অন্য পুলিশ সদস্যরা টাকার ভাগ পেয়েছেন বলে যে অভিযোগ করা হয়েছে, তা পুরোপুরি মিথ্যা।