অপরাধঅর্থনীতিএক্সক্লুসিভ

ঋণখেলাপিদের ছাড় দেবে না সরকার, আসছে যেসব পদক্ষেপ

যারা ঋণের টাকা আত্মসাৎ করে বিদেশে টাকা পাচার করেছেন, তাদের বিদেশে থাকা সম্পদের অনুসন্ধান চলছে। এছাড়া  ওইসব সম্পদ দেশে ফিরিয়ে আনার পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।  ব্যাংক ও ফাইন্যান্স কম্পানির (সাবেক নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান) সাবেক পরিচালক, যারা ঋণখেলাপি হয়েছেন, তাদের শেয়ার বিক্রি করে ঋণের টাকা আদায় করা হবে। এতে পুরো টাকা আদায় না হলে দেশে তাদের নামে যেসব সম্পদ রয়েছে, সেগুলোয় হাত দেওয়া হবে।

এতেও টাকা আদায় না হলে সংশ্লিষ্ট সাবেক পরিচালককে ঋণ শোধের নির্দেশ দেওয়া হবে। শোধ না করলে আইনি ব্যবস্থা অনুযায়ী জেল-জরিমানার পদক্ষেপ নেওয়া হবে। পাশাপাশি ব্যাংকগুলোর ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের শনাক্ত করার প্রক্রিয়া ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। আর যারা সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ঋণ শোধ না করবেন, তাদের ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঘোষণা করে ব্যবসার সুযোগ সংকুচিত করে ফেলা হবে।

খেলাপি ঋণের ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে এবং আদায় বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে। 

ব্যাংকগুলোকেও সম্প্রতি প্রচলিত বিধিবিধানের সর্বোচ্চ প্রয়োগ করে খেলাপি ঋণ আদায় বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বাণিজ্যিক ব্যাংক ও ফাইন্যান্স কম্পানিগুলো খেলাপি ঋণ আদায় বাড়াতে আইনি পদক্ষেপের পাশাপাশি সামাজিকভাবে খেলাপিকে চাপ দিয়ে ঋণ আদায়ের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। 

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বলেন, যেসব পরিচালক জালিয়াতি করে ঋণ নিয়ে খেলাপি হয়েছেন, বিদেশে টাকা পাচার করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।ব্যাংক বা ফাইন্যান্স কম্পানিতে তাদের শেয়ার বিক্রি করে ঋণের টাকা আদায় করা সম্ভব। তাদের নামে দেশে যেসব সম্পদ বা ব্যবসা-বাণিজ্য রয়েছে, সেগুলোও বিক্রি করে টাকা আদায় করা সম্ভব। এছাড়া দেশে তাদের নামে অন্য যেসব স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ রয়েছে, সেগুলোও বিক্রি করার আইনি কাঠামো করতে হবে।

তিনি বলেন, পাচার করা সম্পদ ফিরিয়ে আনা কঠিন ও সময়সাপেক্ষ হলেও ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এছাড়াও আইনের আওতায় এনে তাদের জেল-জরিমানার মুখোমুখি করতে হবে।খেলাপি ও জালিয়াতদের বিরুদ্ধে এসব কঠোর পদক্ষেপ নিলে ভবিষ্যতে আর কোনো পরিচালক এমন অপকর্ম করার সাহস পাবেন না।

সূত্র জানায়, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে ব্যাংক ও ফাইন্যান্স কম্পানিগুলোর (সাবেক নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান) বেশ কয়েকজন সাবেক পরিচালক নজিরবিহীনভাবে লুটপাট করেছেন। এসব ঋণ এখন খেলাপি হতে শুরু করেছে। যে কারণে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণ বেড়ে ২ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে, যা মোট ঋণের ১৭ শতাংশ।

গত সরকারের আমলে ব্যাংকগুলোয় যেভাবে লুটপাটের তথ্য এখন বেরিয়ে আসছে তাতে খেলাপি ঋণের হার আগামী দিনে ৩০ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন গভর্নর। এতে ব্যাংকগুলো আরো দুর্বল হয়ে পড়বে। 

এ আশঙ্কা থেকে ব্যাংক খাতকে উদ্ধার করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগাম সতর্কতামূলক বহুমুখী ব্যবস্থা নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, যেসব সাবেক পরিচালক জালিয়াতি করে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে খেলাপি হয়েছেন, তাদের শেয়ার বিক্রি করে ঋণের টাকা সমন্বয় করা; দেশে তাদের থাকা অন্যান্য সম্পদ বিক্রি করে ঋণ আদায়; দেশ থেকে ঋণের টাকা বিদেশে পাচার করে যেসব সম্পদ গড়েছেন, সেগুলো শনাক্ত করে দেশে ফিরিয়ে আনা। এসব পদক্ষেপেও ঋণের টাকা আদায় না হলে খেলাপি সাবেক পরিচালকদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির নামে দেশে-বিদেশে থাকা সম্পদ থেকে ঋণের টাকা আদায়ের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। 

জালিয়াতদের নামে ব্যাংকে থাকা এফডিআর সমন্বয় করা হবে। এছাড়াও ঋণখেলাপিদের ওপর সামাজিক চাপ সৃষ্টির জন্য তাদের দেশে থাকা কম্পানির অফিস বা কারখানার সামনে ঋণ আদায়ে সভা-সমাবেশ করা, বাড়ির সামনে অবস্থান বা মানববন্ধন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এসব পদক্ষেপ ব্যাংক ও ফাইন্যান্স কম্পানিগুলোর পক্ষ থেকেও নেওয়া হয়েছে। এছাড়া ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি শনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়াও শুরু করেছে ব্যাংকগুলো।

ইতোমধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংক চট্টগ্রামে কুলগাঁও এলাকায় সাদ মুসা গ্রুপের বাণিজ্যিক কার্যালয় এবং খাতুনগঞ্জে বিএসএম গ্রুপের কার্যালয়ের সামনে ব্যাংকের কর্মকর্তারা অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন। দুই গ্রুপের ছয় প্রতিষ্ঠানের কাছে ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকার ঋণ খেলাপি রয়েছে। ন্যাশনাল ব্যাংক ইতোমধ্যে চট্টগ্রামের সাদ মুসা গ্রুপের রেডিয়াম কম্পোজিট টেক্সটাইল, এফএমসি ডকইয়ার্ড, ফ্রেন্ডস মালটি ট্রেড করপোরেশন, ব্রডওয়ে রিয়েল এস্টেটকে ইচ্ছাকৃত খেলাপি হিসাবে শনাক্ত করে তালিকা পাঠিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। এসব প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ রয়েছে ৫ হাজার ৬২৪ কোটি টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত বছরের মার্চে ইচ্চাকৃত খেলাপিদের শাস্তি দিতে নীতিমালা জারি করেছে। সে অনুযায়ী ব্যাংকগুলো এপ্রিলের মধ্যে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি ইউনিট গঠন করেছে। তারা ৩০ জুনভিত্তিক খেলাপি ঋণের স্থিতি ধরে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি শনাক্ত করার কাজ শুরু করেছে। নীতিমালা অনুযায়ী, ইচ্ছাকৃত খেলাপিরা বিদেশ ভ্রমণে যেতে পারবে না, নতুন ট্রেড লাইসেন্স নিতে পারবে না, কম্পানি নিবন্ধনে রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মসের (আরজেএসসি) থেকে নিবন্ধন নিতে পারবে না, বাজারে শেয়ার ছেড়ে পুঁজি সংগ্রহ করতে পারবে না, ইচ্ছাকৃত খেলাপি কোনো রাষ্ট্রীয় পুরস্কার বা সম্মাননা পাবে না এবং গাড়ি, জমি, বাড়ি, ফ্ল্যাট প্রভৃতি নিবন্ধন করতে পারবে না।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করছে, ওই নীতিমালা এখন কার্যকর হওয়ার ফলে যাদের ব্যবসা চলমান, তাদের ঋণের টাকা পরিশোধ করা ছাড়া কোনো বিকল্প থাকবে না। ঋণ শোধ না করলে ব্যবসা করা কঠিন হয়ে পড়বে।

গত সরকারের আমলে ব্যাংক জালিয়াতির দায়ে ছয় ব্যাংকের ২৫ ব্যক্তি ও ৫৬ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার হস্তান্তরে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এর মধ্যে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে থাকা ছয়টি ব্যাংকের সাবেক পরিচালক এবং তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কম্পানিগুলোর শেয়ার রয়েছে। আরও চারটি ব্যাংকের শেয়ারের বিষয়ে তদন্ত চলছে। ওইসব শেয়ার বিক্রি-বাজেয়াপ্ত করে সেগুলোর ঋণের টাকা আদায়ের আইনি প্রক্রিয়া চলছে।

এখন পর্যন্ত জালিয়াতদের নামে থাকা শেয়ার জব্দ করা হয়েছে। এখন বেনামি ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে থাকা শেয়ারের বিষয়ে তদন্ত করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ইতোমধ্যে বেশকিছু বেনামি শেয়ার শনাক্ত করা হয়েছে। সেগুলোও জব্দ করা হবে। এছাড়া জালিয়াতদের নামে ব্যাংকে এফডিআর-এর সন্ধানও পাওয়া গেছে। সেগুলোও জব্দ করা হয়েছে। এগুলোও সমন্বয় করে খেলাপি ঋণ আদায় করা হবে।

সূত্র জানায়, দেশ থেকে পাচার করা অর্থে বিদেশে সম্পদ গড়েছেন-এমন ৬০ ব্যক্তিকে শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে গত সরকারের ঘনিষ্ঠ মন্ত্রী, সংসদ-সদস্য ও ব্যবসায়ী রয়েছেন। তাদের বিদেশে থাকা সম্পদ চূড়ান্তভাবে শনাক্ত করার প্রক্রিয়া চলছে। ইতোমধ্যে প্রাথমিকভাবে তাদের নামে সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে। ওইসব সম্পদ বিদেশে যে অবস্থানে রয়েছে, সেভাবেই থাকবে। শুধু মালিকানা পরিবর্তন করার চেষ্টা করবে সরকার। ফলে পাচার করা সম্পদ দেশের নামে থাকবে। এর সুফল ভোগ করবে রাষ্ট্র।

এদিকে অর্থঋণ আদালত আইনকে সংস্কার করে আরও কঠোর করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বর্তমানে আইন অনুযায়ী গ্রাহক খেলাপি হলে ঋণের বিপরীতে ব্যাংকের কাছে বন্ধকি সম্পদ ব্যাংক গ্রাহককে নোটিশ দিয়েই বিক্রি করে দিতে পারে। এতে টাকা আদায় না হলে গ্রাহকের অন্যান্য সম্পদ বিক্রি করে টাকা আদায়ের জন্য অর্থঋণ আদালতে মামলা করতে পারে। কিন্তু এ মামলা সহজে নিষ্পত্তি হয় না। এজন্য মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে আইনি বিধান আরও কঠোর করা হচ্ছে। কিছু আদালত শনাক্ত করে দেওয়া হবে শুধু অর্থঋণবিষয়ক মামলা নিষ্পত্তি করতে। 

আদালতে জনবল আরো বাড়ানো হবে। বর্তমানে ঋণখেলাপির নামে বিদেশে সম্পদ থাকলে সেগুলো জব্দ করে ঋণ আদায়ের বিধান নেই। এখন এ ধরনের বিধান করা হবে। ঋণখেলাপিদের একটি অংশ উচ্চ আদালতে মামলা করে ব্যাংক কর্তৃক খেলাপি ঋণ ঘোষণাকে আটকে দিচ্ছে। এ খাতে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হাইকোর্টে খেলাপি ঋণসংক্রান্ত রিট মামলা নিষ্পত্তির জন্য বেঞ্চ আরও বাড়ানো হবে। বর্তমানে দুটি বেঞ্চ রয়েছে। এগুলো আগামী তিন মাস শুধু রিট মামলা পরিচালনা করবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ যেমন বাড়ছে, তেমনই ঋণ আদায়ও বাড়তে শুরু করেছে। বিশেষ করে দুর্বল ব্যাংকগুলো বিশেষ উদ্যোগ নেওয়ায় খেলাপি ঋণ আদায় বাড়তে শুরু করেছে। অক্টোবর পর্যন্ত ন্যাশনাল ব্যাংক ১ হাজার কোটি, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ৯০০ কোটি এবং কমার্স ব্যাংক ২৩৩ কোটি টাকার ঋণ আদায় করেছে। এছাড়া জনতা ব্যাংক চট্টগ্রামে খেলাপি ঋণ আদায়ে এস গ্রুপের বিরদ্ধে অর্থঋণ আদালতে মামলা করেছে। ওইসব ঋণ আদায়ে সম্পদ নিলামে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে। এখন পর্যন্ত প্রায় ১ হাজার ৯০০ কোটি টাকার ঋণ খেলাপি হয়েছে।

এছাড়াও ফাইন্যান্স কম্পনিগুলোয় তদন্ত হচ্ছে। গত সরকারের আমলে ৫টি ফাইন্যান্স কম্পানিতে নজিরবিহীন লুটপাট হয়েছে। এর মধ্যে পি কে হালদার গংই নিয়েছেন প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা। পরিচালকরা আত্মসাৎ করেছেন ৫ হাজার কোটি টাকা। এসব ঋণ আদায়ে সংশ্লিষ্ট পরিচালকদের শেয়ারের বিষয়ে তদন্ত হচ্ছে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button