ইসলাম ধর্ম

মায়ের দুধ পান করানো সংক্রান্ত ভুলত্রুটি

মাওলানা মুহাম্মাদ ইয়াহইয়াঃ


শিশুকে বুকের দুধ না দেওয়া
কোনো কোনো মা তার সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াতে চান না, খাওয়ালেও খুব কম খাওয়ান। তারা তাদের শিশুকে কেবল বাজারের গুড়ো দুধ খাইয়ে লালন করে থাকেন। অথচ মার বুকের দুধে সন্তানের হক রয়েছে। এটা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে সন্তানের জন্য প্রদত্ত খাবার। তাই মা’র শারীরিক অসুস্থতা কিংবা এধরনের বিশেষ ওযর না থাকলে সন্তানকে বুকের দুধ থেকে বঞ্চিত করার সুযোগ নেই। এ সম্পর্কে কুরআন মজীদে এসেছে—


وَ الْوَالِدٰتُ یُرْضِعْنَ اَوْلَادَهُنَّ حَوْلَیْنِ كَامِلَیْنِ لِمَنْ اَرَادَ اَنْ یُّتِمَّ الرَّضَاعَةَ.


অর্থ : ‘মাতাগণ নিজেদের বাচ্চাদেরকে পূর্ণ দু’বছর স্তন্যদান করবে, যদি দুধ খাওয়ার পূর্ণ মেয়াদ সমাপ্ত করতে চায়।’ —সূরা বাকারা, আয়াত ২৩৩
তাফসীরবিদগণ বলেন, এ আয়াত থেকে বোঝা যায় যে, সন্তানকে দুধ পান করানো ওয়াজিব এবং আরও বোঝা গেল যে, বিশেষ ওযর ছাড়া স্তন্যদান থেকে বিরত থাকার অবকাশ নেই। —মাআরিফুল কুরআন; তাফসীরে মাযহারী; কুরতুবী; জামিউ আহকামিসসিগার ১/১২৩
তাছাড়া আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানেও এ বিষয়টি স্বীকৃত যে, শিশুর জন্য মায়ের দুধের কোনো বিকল্প নেই। শিশুকে স্তন্যদান শিশুর জন্য যেমন উপকারী তদ্রূপ মার জন্যও উপকারী।
নির্ধারিত সময়ের পরও দুধ পান করানো
অন্যদিকে দেখা যায়, অনেক মা সন্তানকে ৩-৪ বছরও দুধ খাওয়ান। আবার অনেকে আড়াই বছর খাওয়ানো যায় মনে করে এ মেয়াদ পূর্ণ করেন। এটা ভুল। সন্তান অনুর্ধ্ব দুই বছর মার বুকের দুধ খেতে পারবে। দুই বছরের বেশি বয়সী সন্তানকে দুধ পান করানো নাজায়েয। দুই বছর দুধ পান করানোর বিষয়টি সূরা বাকারার ২৩৩ আয়াতে রয়েছে। এছাড়া আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেছেন,
لا رضاع إلا في الحولين
‘মায়ের দুধ পানের সময় দুই বছরই।’ —সুনানে দারাকুতনী ৪/১৭৪; তাফসীরে মাযহারী ১/৩২৩; মাজমাউল আনহুর ১/৫৫২; আত্তাসহীহ ওয়াত্তারজীহ ৩৩৫; ফাতহুল কাদীর ৩/৩০৭-৩০৯
শিশু অন্য খাবারে অভ্যস্ত না হলে আড়াই বছর বুকের দুধ খাওয়ানো
অনেকে মনে করেন, দুই বছরের বেশি দুধ পান করানো যায় না—একথা ঠিক, তবে শিশুর স্বাস্থ্যহানীর আশঙ্কা থাকলে কিংবা অন্য খাবারে অভ্যস্থ না হলে আড়াই বছর বুকের দুধ খাওয়ানোর সুয়োগ আছে। এধারণাও ভুল। শিশুকে দুই বছরের বেশি বুকের দুধ খাওয়ানোর কোনো সুযোগ নেই। শিশু অন্য খাবারে অভ্যস্ত না হলেও। আজকাল বাজারে শিশুর প্রয়োজনীয় পুষ্টি অনুপাতে বিভিন্ন কোম্পানির গুড়ো দুধ পাওয়া যায়। সুতরাং অন্য খাবারে অভ্যস্ত না হলেও তেমন অসুবিধা নেই।
দুই বছরের বেশি যেন বুকের দুধ খাওয়াতে না হয় এ জন্য পূর্ব থেকেই শিশুকে অন্য খাবারে অভ্যস্ত করা উচিত এবং এক বছর আট-নয় মাস হলেই বুকের দুধ কমিয়ে দেওয়া উচিত। যেন যথাসময়ে দুধ ছাড়ানো শিশুর জন্য কষ্টের কারণ না হয়ে যায়।
দুধ-সম্পর্কের বিধি-বিধান বিষয়ে উদাসীনতা
যে ছেলে-মেয়ে এক মায়ের দুধ পান করেছে তারা পরস্পর দুধ-ভাই, দুধ-বোন। এদের মধ্যে বিবাহ-শাদী হারাম। অথচ এ মাসআলাটির প্রতি অনেকেই ভ্রূক্ষেপ করে না। গ্রামে-গঞ্জে মহিলারা শখ করেই একে অন্যের সন্তানকে দুধ খাইয়ে থাকে। আবার অনেক প্রয়োজনবশতও খাওয়ায়। যেমন, মাতার অসুখ হলে বাচ্চাকে পার্শ্ববতী অন্য মা দুধ পান করান, কিন্তু এ বিষয়টি এখানেই শেষ হয়ে যায়। যিনি দুধ পান করালেন তিনিও এটা স্মরণ রাখেন না, অন্যদেরকেও জানানো হয় না। আত্মীয়-স্বজন,পাড়া-পড়শিদেরও বিষয়টি জানা থাকে না। ফলে অনেক সময় দেখা যায়, কোনো কোনো দম্পতির বিবাহ হয়ে সন্তান-সন্ততি হয়ে যাওয়ার পর স্বামী-স্ত্রীর মাঝে দুধ ভাই-বোনের সম্পর্কের খোঁজ পাওয়া যায়। কত জটিল ও ভয়াবহ ব্যাপার! এর জন্য প্রথমত দুধ পান করানোর বিষয়েই সতর্ক হওয়া জরুরি। শিশুর দুধের অভাব বা প্রয়োজন ছাড়া শুধু শখ করে কিংবা হাসি-ঠাট্টাস্থলে অন্য মা-র দুধ পান করানো থেকে বিরত থাকা জরুরি।
আর যদি কোনো শিশুকে দুধ পান করানো হয় তবে এ দুধ-সম্পর্কের কথা আত্মীয়-স্বজনকে জানানো এবং এ সম্পর্কের হেফাযত করা জরুরি। বরং ডায়েরীতে নোট করে রাখা উচিত। এটা শরীয়তের অনেক বড় হুকুম। সমাজে এ বিষয়ে চরম উদাসীনতা লক্ষ করা হয়। —তাফসীরুল মানার ৪/৪৭০, ফিকহুস্ সুন্নাহ ২/৪০৩
দাদি-নানির দুধ পান করা যাবে না?
অনেকে মনে করেন, শিশু তার দাদি-নানির দুধ পান করতে পারবে না। যদি দুধ পান করে তবে বাবা-মার বৈবাহিক সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায় । এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। শিশু তার দাদি-নানির দুধ পান করলে বাবা-মার সম্পর্ক নষ্ট হবে না। —আহসানুল ফাতাওয়া ৫/১২৫
দুধ সম্পর্কের অপব্যবহার
কোনো কোনো এলাকায় দেখা যায়, খালাত ভাই-বোন বা চাচাত ভাই-বোন যাদের মধ্যে পর্দা ফরয তারা বড় হলে পর্দা করতে পারবে না—এই আশঙ্কায় ছোট থাকতেই খালা বা চাচির দুধ খাইয়ে দেওয়া হয় যেন তারা বড় হয়ে পর্দা লঙ্ঘনের গুনাহে পতিত না হয়। যৌথ পরিবারে এমনটি বেশি ঘটে থাকে। অথচ শরীয়তে দুধ-সম্পর্কের বিধান এ উদ্দেশ্যে দেওয়া হয়নি। দুধ সম্পর্কের ভিত্তি হবে সন্তানের দুধের প্রয়োজনকে কেন্দ্র করে। পর্দার হুকুম আদায় করতে পারবে না এ আশঙ্কায় দুধ পান করানো আদৌ সমীচীন নয়। কারণ স্বভাবগত কারণে মানুষ একেবারে পশুতে পরিণত না হলে কোনো রক্ত সম্পর্কীয় মাহরামের প্রতি কামভাবের উদ্রেক হয় না, কিন্তু দুধ ভাই-বোনের মধ্যে যেহেতু রক্তের সম্পর্ক নেই তাই তাদের মধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ে কামভাবের সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এজন্য ফিকহের বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য কিতাবে দুধভাই—বোনের একত্রে নির্জনে অবস্থান করাকে নাজায়েয বলা হয়েছে। —ফাতাওয়া শামী ৬/৩৬৯
দুধ-সম্পর্কের কারণে দুধ ভাই-বোনের দেখা সাক্ষাত বৈধ হয়ে যায় এবং তাদের মধ্যে বিবাহ—শাদী হারাম হয়ে যায়। কিন্তু তারা সকল ক্ষেত্রে রক্ত সম্পর্কীয় আসল মাহরামের মতো নয়। আজকাল দুধভাই বোনের চালচলন আপন ভাই-বোনের মতোই দেখা যায়, যা আদৌ কাম্য নয়। একইভাবে তাদের একাকী সফরসম দূরত্বে যাওয়াও ঠিক নয়।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button